মো: তুহিন বাবু : মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। প্রতিটি নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত রেখেছে। তবে কিছু পরিস্থিতিতে, যখন জীবন বা সম্পদ তাৎক্ষণিকভাবে হুমকির মুখে পড়ে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা পাওয়া সম্ভব হয় না, তখন ব্যক্তি নিজেই আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার বিধান দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৯৬ থেকে ১০৬ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যা একজন নাগরিককে সীমিত পরিসরে আত্মরক্ষার অধিকার প্রদান করে।
দণ্ডবিধির ৯৬ ধারা স্পষ্টভাবে আত্মরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেছে, যেখানে বলা হয়েছে “Nothing is an offence which is done in the exercise of the right of private defence.” অর্থাৎ, আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করে সংঘটিত কোনো কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। তবে এটি নির্দিষ্ট কিছু সীমার মধ্যে কার্যকর এবং যথেচ্ছা বলপ্রয়োগ বা প্রতিশোধমূলক ব্যবহারের সুযোগ নেই।
দণ্ডবিধির ৯৭ ধারা এই অধিকারের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের এবং অন্যের দেহ রক্ষার অধিকার রাখেন। একইভাবে, কেউ নিজের কিংবা অন্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষার জন্য আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। অর্থাৎ, আত্মরক্ষার অধিকার কেবল ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্যই নয়, বরং অন্য কারও জীবন বা সম্পত্তি রক্ষার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়।
আরও পড়ুন : অবকাশ শেষে হাইকোর্টের ৪৯ বেঞ্চে চলবে বিচারকাজ
তবে আইন আত্মরক্ষার অধিকার দিলেও, এর সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করেছে দণ্ডবিধির ৯৯ ধারা। এতে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি এমন পরিস্থিতিতে পড়েন যেখানে তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে পারেন, তাহলে আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করা যাবে না। তাছাড়া, আত্মরক্ষার নামে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা যাবে না। যদি আত্মরক্ষার নামে অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত সহিংসতা চালানো হয়, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সরকারি কর্মচারী যদি আইনসম্মতভাবে তার দায়িত্ব পালন করেন এবং এতে কারও প্রাণনাশ বা গুরুতর জখমের আশঙ্কা না থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করা যাবে না। তবে, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেন এবং এতে প্রাণনাশের আশঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধেও আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করা বৈধ হবে।
কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার অধিকারের প্রয়োগ করে হত্যা করাও আইনসিদ্ধ হতে পারে। দণ্ডবিধির ১০০ ধারা অনুযায়ী, ছয়টি বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যক্তি আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করে হামলাকারীকে হত্যা করতে পারেন। এই ছয়টি ক্ষেত্র হলো- (১) প্রাণনাশের আশঙ্কাজনক আক্রমণ, (২) গুরুতর আঘাতের আশঙ্কাজনক আক্রমণ, (৩) ধর্ষণের অভিপ্রায় নিয়ে আক্রমণ, (৪) অস্বাভাবিক যৌনাচার চরিতার্থ করার অভিপ্রায় নিয়ে আক্রমণ, (৫) অপহরণের অভিপ্রায় নিয়ে আক্রমণ এবং (৬) অবৈধভাবে আটক করার অভিপ্রায় নিয়ে আক্রমণ, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে তিনি সরকারি কর্তৃপক্ষের সহায়তা পাবেন না। এই পরিস্থিতিতে যদি আত্মরক্ষার নামে হত্যার ঘটনা ঘটে, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না, তবে অবশ্যই দণ্ডবিধির ৯৯ ধারার শর্তাবলি মেনে চলতে হবে।
এছাড়া, দণ্ডবিধির ১০৩ ধারা অনুযায়ী, চারটি ক্ষেত্রে সম্পত্তি রক্ষার্থে আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করে হামলাকারীকে হত্যা করাও আইনসম্মত হতে পারে। এই চারটি ক্ষেত্র হলো—(১) দস্যুতা বা ডাকাতি প্রতিরোধ, (২) রাত্রিকালে ঘর ভেঙে অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ, (৩) বাসগৃহ বা সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধ এবং (৪) চুরি বা অনধিকার গৃহপ্রবেশ প্রতিরোধ, যেখানে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে। অর্থাৎ, যদি কেউ সম্পত্তি ধ্বংস বা দখলের উদ্দেশ্যে প্রাণনাশের আশঙ্কাজনক আক্রমণ চালায়, তাহলে সম্পত্তির মালিক আত্মরক্ষার অধিকারের প্রয়োগ করে আক্রমণকারীকে হত্যা করতে পারেন।
আইন নির্ধারণ করে দিয়েছে যে আত্মরক্ষার অধিকার কখন শুরু হবে এবং কখন শেষ হবে। দণ্ডবিধির ১০২ ধারা অনুসারে, যখনই কারও জীবনের প্রতি হুমকি বা আক্রমণের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, তখনই আত্মরক্ষার অধিকার কার্যকর হয় এবং এই হুমকি দূর হলে আত্মরক্ষার অধিকার শেষ হয়ে যায়। দণ্ডবিধির ১০৫ ধারা অনুযায়ী, সম্পত্তির ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার অধিকার শুরু হয় তখন, যখন অবৈধ হস্তক্ষেপ বা আক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হয় এবং এটি চলমান থাকা পর্যন্ত এই অধিকার বলবৎ থাকে।
আরও পড়ুন : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বার কাউন্সিলের নতুন নির্দেশনা, তালিকা না দিলে রেজিস্ট্রেশন স্থগিত
আইন ব্যক্তি বিশেষকে আত্মরক্ষার অধিকার দিলেও, এটি সীমাহীন নয়। আত্মরক্ষার নামে অনর্থক সহিংসতা বা প্রতিহিংসার জন্য এই অধিকারের অপব্যবহার করলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই আইনের নির্ধারিত শর্তাবলি মেনে চলতে হবে এবং এটি শুধুমাত্র ন্যায়সঙ্গত প্রতিরক্ষার জন্যই ব্যবহার করা উচিত।
লেখক : শিক্ষার্থী, আল ফিকহ এন্ড ল বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া; সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।