রাশিদা চৌধুরী নীলু : বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা এক নৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ফৌজদারি মামলা। এই পরিস্থিতিতে সরকার বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে ‘মধ্যস্থতা’ বা ‘মেডিয়েশন’ প্রক্রিয়াকে ফৌজদারি আইনের অংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় পক্ষদ্বয় নিরপেক্ষ এক বা একাধিক মধ্যস্থতাকারীর সহায়তায় আদালতের বাইরে আপসে পৌঁছাতে পারবেন। উদ্দেশ্য মামলার সংখ্যা হ্রাস, বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনা এবং আদালতের উপর থেকে চাপ কমানো।
পেটি অপরাধ যেমন হালকা মারামারি, পারিবারিক কলহ, হুমকি, চুরির মত ছোটখাটো অপরাধে আদালতে মামলা দায়েরের আগে বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতার প্রক্রিয়ায় যাওয়ার প্রস্তাব ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট পরামর্শকগণ এ প্রক্রিয়াকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার পরামর্শ দিয়েছেন এবং এটিকে বিচারব্যবস্থার ‘ফাস্ট ট্র্যাক সল্যুশন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মধ্যস্থতা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতির (ADR) অন্যতম অনুশীলন, যা বিশ্বব্যাপী বিশেষত পারিবারিক ও সিভিল মামলায় ইতিবাচক ফল দিয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়,
এই পদ্ধতি ফৌজদারি আইন, বিশেষ করে গুরুতর অপরাধে কতটা প্রযোজ্য এবং উপযোগী?
প্রস্তাবিত মধ্যস্থতার সপক্ষে যেসব যুক্তি রয়েছে, সেগুলোও উপেক্ষণীয় নয়।
প্রথমত, মামলার দীর্ঘসূত্রিতায় বিচারপ্রার্থী জনগণ যেমন ভোগান্তির শিকার হন, তেমনি বিচারব্যবস্থার ওপরও চাপ বেড়ে যায়। একটি মারামারি বা মানহানির মামলার নিষ্পত্তি হতে এক দশক লেগে যায়, যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনৈতিক। যদি আদালতের বাইরে সম্মতির ভিত্তিতে মীমাংসার সুযোগ থাকে, তাহলে তা মামলার সংখ্যা হ্রাসে অবদান রাখবে এবং বিচারব্যবস্থার সময় ও সম্পদ আরও গুরুতর মামলায় ব্যয় করা যাবে।
দ্বিতীয়ত, আদালতের রায় সম্পর্ককে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে, যেখানে মধ্যস্থতা রক্ষা করতে পারে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন।
তৃতীয়ত, ন্যায়ের একটি মানবিক রূপ দেখা দেয় মধ্যস্থতার মাধ্যমে, যেখানে আপস, ক্ষমা, আত্ম উপলব্ধি এবং পুনর্মিলনের সুযোগ থাকে। এ ধরনের সংস্কৃতি সামাজিক শান্তি ও সহনশীলতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
তবে এই যুক্তিগুলো যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, বাস্তবতা আরও জটিল এবং শঙ্কাবহ। বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে শক্তিশালী ও দুর্বল পক্ষের মাঝে ভারসাম্য নেই। ফলে সম্মতি অনেক সময়ই মুখবন্ধ করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক প্রভাব, সামাজিক চাপ, পারিবারিক মান-সম্মান কিংবা নারীর প্রতি বৈষম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অভিযোগকারী পক্ষকে আপসে বাধ্য করা নতুন কিছু নয়। প্রশ্ন হলো, যেখানে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ একটি সমাজবিরোধী কর্ম, রাষ্ট্র যেখানে নিজেই মামলার পক্ষ হয়ে দাঁড়ায়; সেখানে এই প্রক্রিয়াকে ‘ব্যক্তিগত আপস’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য?
এই প্রস্তাবে গুরুতর অপরাধ যেমন অবহেলাজনিত মৃত্যু, ধর্ষণ, ডাকাতি, খুনের হুমকি কিংবা রাজনৈতিক সহিংসতা কীভাবে মূল্যায়িত হবে? যদি এসব ক্ষেত্রেও মধ্যস্থতার সুযোগ রাখা হয়, তাহলে সেটি ন্যায়বিচারের ক্ষয় এবং অপরাধীদের অনুপ্রেরণার পথ করে দেবে। আবার যদি কেবল পেটি অপরাধেই সীমিত রাখা হয়, তাহলে সেটির সংজ্ঞা ও সীমা নির্ধারণ করতে হবে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগের মাত্রা পরিবর্তিত হতে পারে তদন্তের সময়।
এছাড়া প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় মধ্যস্থতাকারী কারা হবেন, কীভাবে তাঁদের মনোনয়ন হবে, তাঁরা কতটা প্রশিক্ষিত ও নিরপেক্ষ থাকবেন; এ প্রশ্নগুলোর জবাব এখনও অস্পষ্ট। একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক মধ্যস্থতা কাঠামো ছাড়া এই প্রক্রিয়া দুর্নীতির নতুন উপায় হয়ে উঠতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে সালিশি পদ্ধতির যে সব অপব্যবহার আমরা দেখেছি, মধ্যস্থতা সেই একই ফাঁদে পড়লে এর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, মধ্যস্থতা সফল তখনই হয় যখন এটি কঠোর আইনি কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয় এবং কোনো চাপ ছাড়াই পক্ষদ্বয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশগ্রহণ করে। ভারত ২০২৩ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘মেডিয়েশন অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেছে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় গুরুতর অপরাধে রাষ্ট্র নিজেই কার্যক্রম চালিয়ে যায়; সেখানে আপসের সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে দুর্বলদের কণ্ঠস্বর অনেক সময় উচ্চারিত হয় না, সেখানে এই প্রক্রিয়াকে কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত করতে হলে আইনগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে কিছু আইনের ধারা অনুযায়ী আগে থেকেই আপসযোগ্য অপরাধ রয়েছে, যেমন—দণ্ডবিধির ৩২৩ (সাধারণ আঘাত), ৩৫২ (আক্রমণ), ৫০৪, ৫০৬ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর সম্মতিতে বিচার স্থগিত রাখা বা আপসে নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এগুলোর সীমাবদ্ধতা ও অস্পষ্টতা এতটাই বেশি যে তা পুরোপুরি মধ্যস্থতার কাঠামোকে ধারণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন একটি নতুন, আধুনিক এবং কার্যকর মধ্যস্থতা আইন, যেখানে অপরাধ শ্রেণি, মধ্যস্থতাকারীর যোগ্যতা, আপসের প্রক্রিয়া, পর্যবেক্ষণ ও আপিল ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে।
একই সঙ্গে প্রয়োজন একটি জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান, যেখানে সাধারণ মানুষ জানবে কী ধরনের মামলায় মধ্যস্থতা প্রযোজ্য, কীভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়, কীভাবে মধ্যস্থতার মাধ্যমে আপসে গেলে অভিযোগকারী তার অধিকার হারাবেন না। এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজ, আইনজীবী, মানবাধিকার সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে জাতীয় সংলাপ দরকার।
ফৌজদারি আইন মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় ন্যায়ের প্রতীক। এটি শুধু ব্যক্তি,ব্যক্তির সম্পর্ক নয়, বরং সমাজ-রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলার সুরক্ষার হাতিয়ার। একে পুরোপুরি আপসনির্ভর করে তুললে সমাজে অপরাধের প্রতিরোধ শক্তি দুর্বল হয়ে যাবে। অপরাধী জানবে যে, টাকা বা প্রভাব খাটিয়ে সে মধ্যস্থতার মাধ্যমে রেহাই পেয়ে যেতে পারে। এই ধারণা ভয়ঙ্কর।
মধ্যস্থতা প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী হলেও, এটি কোনো বিচারের বিকল্প নয়। বরং এটি হতে পারে বিচারের একটি সহায়ক পথ। যেখানে সম্পর্ক, মানবিকতা ও সামাজিক বাস্তবতার স্বীকৃতি দেওয়া হবে, তবে কখনও ন্যায়ের মানদণ্ডকে উপেক্ষা করে নয়। মধ্যস্থতা যেন ন্যায়ের বিকৃতি না হয়ে ওঠে, বরং হয় ন্যায়ের এক উদার ও সমবেদ্য ভঙ্গি। এটাই হওয়া উচিত বাংলাদেশের আইন সংস্কারের মৌলিক লক্ষ্য।
বিচার মানে রায় নয়, প্রক্রিয়াটিও পবিত্র হোক,
ন্যায়ের নোঙরে বাঁধা থাকুক প্রতিটি আপসের লোক।
মধ্যস্থতা আসুক সহায়ক হয়ে সুবিচারের দলে,
অপরাধ না পায় আশ্রয় কোনো গোপন আপসচালে।
লেখক : রাশিদা চৌধুরী নীলু; আইনজীবী, আপিল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।