ব্যারিস্টার মোহাম্মদ ইসমাইল
ব্যারিস্টার মোহাম্মদ ইসমাইল

“সিভিল মামলা চলমান” – এই অজুহাতে রেজিস্ট্রি দলিল অকার্যকর?

ব্যারিস্টার মোহাম্মদ ইসমাইল : বাংলাদেশের বহু নাগরিক সরকারি রেজিস্ট্রি দলিল, নামজারি খতিয়ান ও খাজনা রসিদের মাধ্যমে তাদের জমির উপর বৈধ মালিকানা ও দখলের স্বীকৃতি পান। রাষ্ট্র নিজেই সেই কাগজপত্রকে স্বীকৃতি দিয়ে রাজস্ব গ্রহণ করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, বেআইনি দখল বা জোরপূর্বক উচ্ছেদের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগী যখন প্রশাসনের শরণাপন্ন হন, তখন কিছু এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট “সিভিল মামলা চলমান” – এই যুক্তি দেখিয়ে দখল পুনরুদ্ধারের আবেদন খারিজ করছেন। এই ধরনের আচরণ কেবল আইনের অপপ্রয়োগই নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের মৌলিক চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান। এই প্রেক্ষাপটে এই লেখাটি কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন উত্থাপন করে—

প্রথমত, সরকারের দেওয়া রেজিস্ট্রি দলিল, নামজারি খতিয়ান ও খাজনার কাগজ কি সরকারের কাছে কোনো আইনগত মূল্য রাখে? উক্ত দলিলসমূহের ভিত্তিতে সরকার যদি নাগরিকের মালিকানা স্বীকৃতি দেয় এবং রাজস্ব গ্রহণ করে, মালিকানা, দখল ও অধিকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে কেন কিছু এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সেগুলিকে অগ্রাহ্য করে কেবল “সিভিল মামলা চলমান” — এই অজুহাতে দখল পুনরুদ্ধারের আবেদন খারিজ কর প্রার্থীদেরকে বিচার থেকে বঞ্চিত করছেন। এই আচরণ কি আইন, প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা ও জনগণের ন্যায়বিচারের অধিকার লঙ্ঘন নয়?

দ্বিতীয়ত, সরকার জনগণের সুরক্ষার জন‍্য ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ বানিয়েছে অথচ কিছু কিছু এক্সিকিউটিভ ম‍্যাজেস্ট্রেট উক্ত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। তারা কি যেনে বুঝে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইন বুঝেও অবজ্ঞা করছেন অমান‍্য করছেন নাকি আইন-কানুন বুঝেন না? যদি জেনে বুঝে নিজের ক্ষমতার অপব‍্যবহার করেন তাহলে এটি প্রশাসনিক দায়িত্বহীনতা ও ক্ষমতার অপব‍্যবহার নয় কি?

আর যদি একজন ম্যাজিস্ট্রেট আইন না পড়েন বা সঠিকভাবে না বোঝেন, তাহলে তিনি কীভাবে এই পদে বহাল আছেন? তাহলে এইসব অযোগ‍্য লোকদের কেন দায়িত্ব দেওয়া হলো? জনগণের অধিকার নিয়ে কাজ করা একজন কর্মকর্তা যদি আইনই না বোঝেন, তাহলে তার পদে বহাল থাকা প্রশাসনিক ব্যর্থতা। এ ধরনের ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করা সমগ্র ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

তৃতীয়ত, আইন কি জনগণের উপকারের জন‍্য করা হয়েছে নাকি ক্ষতি কারার জন‍্য? আমরা জানি জনগনের উপকারের জন‍্য করা হয়েছে। যখন একজন বৈধ মালিক রেজিস্ট্রি দলিল, নামজারি, খাজনা পরিশোধ করে বসবাস করছেন এবং পরবর্তীতে তার দখল জবরদখল হয় — তখন তিনি আইনের মাধ্যমে প্রতিকার চাওয়ার অধিকার রাখেন। তাহলে কেন কিছু এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বেআইনি দখলদারদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ান? জনগণের উপকারতো দূরের কথা অপরাধীদের বাঁচানোর জন‍্য আইনের অপব্যবহার করছে!

চতুর্থত, যারা আইন মানেন না, দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন এবং অন্যায়কারী বেআইনি দখলদারদের পক্ষে অবস্থান নেন — তারা কি রাষ্ট্রের শপথ রক্ষা করছেন? তারা কি জনগণের বন্ধু, নাকি সংবিধানের শত্রু? তারা রাষ্ট্র ও সংবিধানের প্রতি অনুগত নন। এই দায়িত্বশীল পদে তাদের নিয়োগ কীভাবে হলো?

পঞ্চমত, যদি রাষ্ট্রীয় দলিলের কোনো মূল্য না থাকে, যদি আইন প্রয়োগ না হয়, যদি জনগণের আবেদন কেবল “সিভিল মামলা চলছে” বলে খারিজ হয় — তাহলে সরকার ও প্রশাসনের কাছে একজন সাধারণ নাগরিকের মুল‍্য কি তা বা কোথায় যাবেন? কার কাছে বিচার চাইবেন?

ষষ্ঠত, যারা নিরীহ ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা কে নেবে? প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কি বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে? নাকি “বিচারহীনতার সংস্কৃতি” আবারও বিস্তার লাভ করছে?

আইন ও ন্যায়বিচার কেবল নথিপত্র কিংবা আদালতের দেয়ালে সীমাবদ্ধ কোনো বিষয় নয়। এগুলো রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থার ভিত্তি। আর সেই ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে যখন কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেআইনি দখলদারদের পক্ষ নেন, আইনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে ন্যায়বিচার বঞ্চিত করেন। রাষ্ট্রীয় দলিল যদি কার্যকর না হয়, যদি ন্যায্য আবেদন “সিভিল মামলা চলছে” বলে বাতিল হয়, তাহলে প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কোথায়?

এই প্রশ্নগুলো শুধু ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়—এগুলো হলো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনসাধারণের মৌলিক উদ্বেগ। প্রশাসনের দায়িত্বশীল অংশ, আইন প্রণয়নকারী, এবং বিচার বিভাগের উচিত এই প্রশ্নগুলোর সুনির্দিষ্ট জবাব দেওয়া। না হলে “বিচারহীনতার সংস্কৃতি” আরও গভীর হবে এবং জনগণের আস্থা ধসে পড়বে। এখনই সময়—আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা নিশ্চিতকরণ এবং ন্যায়বিচারের মর্যাদা রক্ষার।

লেখক : যুক্তরাজ্যের লিংকনস ইন (Lincoln’s Inn) এর সদস্য এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত অ্যাডভোকেট হিসেবে আইন পেশায় নিযুক্ত আছেন।