মাসুদুর রহমান : ২০২৫ সালে ফৌজদারী কার্যবিধিতে সংযোজিত নতুন ধারা ১৭৩ক বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একটি আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই ধারা অনুসারে, কোনো মামলার তদন্ত শেষ হওয়ার পূর্বেই পুলিশ কমিশনার, জেলা পুলিশ সুপার কিংবা তাদের সমমানের কর্মকর্তা, প্রয়োজন বুঝে তদন্ত কর্মকর্তাকে অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদন (Interim Investigation Report) দাখিলের নির্দেশ দিতে পারেন।
যদি এতে দেখা যায়, কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট সেই অভিযুক্তকে অব্যাহতি দিতে পারেন। তবে পরবর্তীতে তদন্তে যদি নির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তখন তাকে আবার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগও রাখা হয়েছে। এ ধারা প্রথমবারের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার হাতে এমন এক ক্ষমতা তুলে দিয়েছে, যা একদিকে যেমন নিরপরাধ ব্যক্তির মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে, তেমনি অপব্যবহার হলে তা বিচারবিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করতে পারে।
সুবিচার নিশ্চিতকরণে একটি আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একটি বড় সংকট হলো বিচারাধীন বন্দিদের দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা। অনেক সময় দেখা যায়, একজন ব্যক্তি মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার হয়ে বছরের পর বছর কারাগারে পড়ে থাকেন, অথচ তদন্ত শেষে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। ধারা ১৭৩ক এর মাধ্যমে তদন্ত চলাকালেই যদি এমন কোনো প্রাথমিক প্রতিবেদন পাওয়া যায়, যেখানে দেখা যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ, তাহলে আদালত তাকে অব্যাহতি দিতে পারেন। এটি একজন নিরপরাধ মানুষের জীবন, মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশে মামলার জট এবং বিচার বিলম্ব বহুল আলোচিত সমস্যা। আদালতের মূল্যবান সময় এমন অনেক মামলায় ব্যয় হয়, যেখানে আসলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনো সত্যিকারের প্রমাণ নেই। ধারা ১৭৩ক প্রয়োগ করে যদি প্রাথমিক পর্যায়েই অপ্রাসঙ্গিক বা ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো ছেঁটে ফেলা যায়, তাহলে আদালতের উপর থেকে মামলা পরিচালনার চাপ অনেকাংশে কমবে। ফলে, প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের জীবন, স্বাধীনতা ও আইনি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যদি বছরের পর বছর জেলে থাকে, তবে সেটি শুধু মানবিক দিক থেকেই দুর্ভাগ্যজনক নয় এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ও। তার থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা, আদালতে প্রোডাকশন, ও তদন্ত সবকিছুতেই ব্যয় হয় জনগণের অর্থ। ধারা ১৭৩ক -এর যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে যদি এসব অপ্রয়োজনীয় ব্যয় রোধ করা যায়, তাহলে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের একটি পথ হয়ে উঠতে পারে।
অধিকন্তু , এই ধারা চালু হওয়ায় পুলিশ ও তদন্ত কর্মকর্তাদের ওপর দায়িত্ব বাড়বে যে, তারা কোনো ব্যক্তিকে আটক করে রাখার আগে আরও বেশি নির্ভুল ও স্বচ্ছ তদন্ত করতে বাধ্য হবেন। কারণ এখন শুধু চূড়ান্ত নয়, তদন্ত চলাকালীন রিপোর্টও আদালতে উপস্থাপন করতে হতে পারে। এতে তদন্ত মান উন্নয়ন ও পেশাগত সততা নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
বিচারহীনতার ছায়া না কি ন্যায়বিচারের বিপর্যয়?
ধারা ১৭৩ক পুলিশ কমিশনার, জেলা পুলিশ সুপার বা সমমানের কর্মকর্তা যাদের ওপর তদারকির ভার দেওয়া হয়েছে তাদের হাতে একটি বড় ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন রাজনৈতিক প্রভাব, ঘুষ, ও পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (TIB) ২০২৩ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনগণ যে সব সেবাখাতকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করে, তার মধ্যে পুলিশ বিভাগ রয়েছে শীর্ষে। এই বাস্তবতায়, যদি কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তা বা তার তদারক কর্মকর্তা, কারো প্রতি প্রভাবিত হন বা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন, তবে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে “অপর্যাপ্ত প্রমাণ” দেখিয়ে অভিযুক্তকে মুক্ত করে দিতে পারেন।
১৭৩ক ধারা মূলত অপরাধী সনাক্তকরণের আগে নির্দোষ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হয়, সেই লক্ষ্য নিয়ে চালু হয়েছে। কিন্তু এ বিধানটি যদি অপব্যবহৃত হয়, তবে ভিকটিমের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সরাসরি হুমকির মুখে পড়েবে।
উদাহরণস্বরূপ, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন বা এসিড নিক্ষেপের মতো মামলায় অপরাধীরা প্রায়ই প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা করে এবং ভিকটিমকে হুমকি দিয়ে আপস করতে বাধ্য করে। যদি তদন্তের মাঝপথে পুলিশ প্রতিবেদনে বলে দেয় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে “পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই” এবং তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তাহলে তা ভিকটিমের মনে স্থায়ী হতাশা সৃষ্টি করবে।
আরও পড়ুন : ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ জারি রাষ্ট্রপতির
ইহাছাড়াও যদি সাধারণ মানুষ বারবার দেখে যে, অপরাধী ব্যক্তি প্রভাব খাটিয়ে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দিয়ে মুক্তি পাচ্ছে, তবে জনগণের মধ্যে বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা কমে যাবে। “বিচার কেবল ধনীদের জন্য”-এই ধারণা আরও গভীর হবে। এটি ন্যায্যতা ও আইনের শাসনের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। বিশেষ করে, যদি সাধারণ নাগরিকরা দেখেন যে রাজনৈতিক নেতারা, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রভাবশালী সদস্যরা বারবার এই ধারার অপব্যবহার করে অব্যাহতি পাচ্ছেন, তখন তারা মনে করবেন বিচার তাদের জন্য নয়, শুধুমাত্র ক্ষমতাবানদের জন্য।
ধারা ১৭৩ক -এর উপধারা (৩)-এ বলা হয়েছে, যদি কেউ অন্তর্বর্তী তদন্তে অব্যাহতি পেলেও পরে তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত তদন্তে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাকে পুনরায় অভিযুক্ত করা যাবে। কিন্তু এই বিধানটি বাস্তব প্রয়োগে জটিল। কারণ একবার কেউ আদালতের আদেশে অব্যাহতি পেয়ে গেলে পরবর্তীতে তাকে আবার অভিযুক্ত করলে তা “double jeopardy” (একই অপরাধে একাধিকবার বিচার) এর প্রশ্ন তুলতে পারে।
যদিও আইন অনুযায়ী এটি ফাইনাল জাজমেন্ট নয়, তথাপি অভিযুক্ত পক্ষ উচ্চ আদালতে গিয়ে বলতেই পারে—“আমার বিরুদ্ধে আদালত একবার রায় দিয়ে দিয়েছেন, এখন আবার মামলা চালানো বেআইনি।” এই অবস্থায় মামলার বিচারপ্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
১৭৩ক -এর প্রয়োগে একটি গুরুতর প্রশ্ন উঠতে পারে তদন্তকারী কর্মকর্তার মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে যদি ম্যাজিস্ট্রেট অব্যাহতি দেন, তবে সেখানে বিচারিক স্বাধীনতা কোথায়? পুলিশ প্রশাসনের তদন্ত আর বিচারকের বিচার এই দুটি বিষয়কে মিশিয়ে ফেললে বিচারিক স্বাধীনতা খর্ব হয়। আদালত যদি শুধুমাত্র পুলিশের প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেটি একটি “Police driven judiciary” হয়ে দাঁড়াতে পারে। অথচ বিচার বিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হওয়ার কথা, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত তথ্য, যুক্তি ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হতে হবে।
অপব্যবহার রোধ ও সুফল নিশ্চিতকরণে করণীয়
ফৌজদারী কার্যবিধির নতুন ধারা ১৭৩ক -এর কার্যকর ও ন্যায্য প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
প্রথমত, তদন্ত কর্মকর্তা ও তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো প্রকার পক্ষপাত, ঘুষ বা রাজনৈতিক চাপের প্রভাব না পড়ে।
দ্বিতীয়ত, ম্যাজিস্ট্রেট যেন কেবল পুলিশ প্রতিবেদনের উপর নির্ভর না করে স্বাধীনভাবে মূল্যায়ন করেন, তার জন্য ‘রিজনড অর্ডার’ বাধ্যতামূলক করা উচিত।
তৃতীয়ত, অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমার আগে ভুক্তভোগী বা বাদী পক্ষকে শুনানির সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে তারা তাদের বক্তব্য নিজে বা আইনজীবীর মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারেন।
চতুর্থত, অপব্যবহার রোধে একটি স্বাধীন তদারকি ইউনিট গঠন করে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের যথার্থতা যাচাই করতে হবে।
একইসঙ্গে, কোনো অভিযুক্ত অব্যাহতি পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে পরবর্তীতে প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে পুনরায় অভিযুক্ত করার বিধানটিও স্পষ্টভাবে আদালতের অনুমোদনের মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, ফৌজদারী কার্যবিধিতে সংযোজিত নতুন ১৭৩ক ধারা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক সংস্কার হয়ে উঠতে পারে, যদি এটি সঠিকভাবে, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়। এটি যেমন নির্দোষ নাগরিকদের মুক্তির পথ খুলে দেয়, তেমনি অপব্যবহারের ক্ষেত্রেও দরজা খুলে দিতে পারে। কাজেই এই আইনের সফলতা নির্ভর করবে রাষ্ট্র, পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সমন্বিত সদিচ্ছা ও জবাবদিহিমূলক আচরণের উপর।
লেখক: মাসুদুর রহমান; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। E-Mail : masud.law22@gmail.com