বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)

বিমা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ, বাড়ছে নিয়ন্ত্রণ ও জরিমানা

বিমা খাতে শৃঙ্খলা আনতে বিদ্যমান আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সংশোধনের আওতায় আনা হচ্ছে বিমা আইন এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন (আইডিআরএ আইন)—দুইটি আইনই। ইতিমধ্যে সংশোধিত আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অংশীজন, বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হচ্ছে।

কেন এই সংশোধন?

আইডিআরএ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিমা আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে বিমা খাতের উন্নয়ন, বিমা গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও আইনটিকে যুগোপযোগী করার উদ্দেশ্যে। আর আইডিআরএ আইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে এটিকে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি বিমা খাতের অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা দূর করতে।

আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম বলেন, আইন দুটি হওয়ার (২০১০) পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। তাই বেশ কিছু বিষয় হালনাগাদ করার সময় এসেছে। আইডিআরএর ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা দরকার। বিদ্যমান আইনে কোনো বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ আইডিআরএ ভেঙে দিতে পারে না। আইন সংশোধন হলে তা সম্ভব হবে।

বিমা আইন সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিমা কোম্পানিকে কেন্দ্রীভূত করা যাবে না। কোনো পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, একক বা অন্যের সঙ্গে যৌথভাবে বা উভয়ভাবে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকতে পারবে না। এ ছাড়া শর্ত ও নির্দেশনা অনুযায়ী বিমা কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে কি না, এখন থেকে তা সময়ে সময়ে পরীক্ষা করবে আইডিআরএ।

আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৮২টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টি জীবন বিমা ও ৪৬টি সাধারণ বিমা। গত ১৪ বছরে ২৬ লাখের বেশি বিমা পলিসি বাতিল হয়েছে। ২০২৪ সালে বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল ৫৭ শতাংশ, অর্থাৎ ১৬ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার দাবির বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।

মূল প্রস্তাবনা:

  • পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা:কোনো বিমা কোম্পানি বা এর সহায়ক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের স্বার্থহানি করলে আইডিআরএ সেই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করতে পারবে। পর্ষদ ভেঙেও দিতে পারবে, যা পরে দুই বছরের মধ্যে পুনর্গঠন করতে হবে।

  • শেয়ার ধারণের সীমা: কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যরা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার রাখতে পারবেন। বিদ্যমান বিমা আইনে ‘পরিবার’ বলতে স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই ও বোন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীলদের চিহ্নিত করা আছে। সংশোধন করে পরিবার সংজ্ঞাতে জামাতা ও পুত্রবধূকে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সবাই’ কথাটি।

  • বেআইনি বিমা ব্যবসার ঘোষণা:কোনো কোম্পানি বেআইনি বিমা ব্যবসা করলে বা আইডিআরএর নির্দেশ অমান্য করলে সংস্থাটি দৈনিক পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে তা প্রকাশ করতে পারবে। এর আগে ওই কোম্পানিকে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হবে। এ ছাড়া কোম্পানির নাম পরিবর্তনে আইডিআরএর অনুমতি নিতে হবে।

  • তল্লাশি ও সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা:কোনো বিমা কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের উপস্থিতি নেই বলে যদি মনে করেন আইডিআরএর কর্মকর্তারা, তাহলে তাঁরা সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানির অফিসে প্রবেশ করে তল্লাশি চালাতে পারবেন। দাবি নিষ্পত্তির জন্য কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রিও করতে পারবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

  • জীবনবিমা কমিশন হ্রাস-বৃদ্ধি: জীবনবিমা এজেন্টদের কমিশনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে আইনি সংশোধনীতে। প্রথম বছরের প্রিমিয়ামের ওপর কমিশন ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। তবে বিমা নবায়নের ক্ষেত্রে কমিশন বাড়বে। দ্বিতীয় বছরে ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ১৫ শতাংশ। তবে পরবর্তী বছরগুলোয় ৫ শতাংশ হার অপরিবর্তিত থাকবে।

  • পরিচালকের যোগ্যতা:পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বিমা কোম্পানির সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিতে পারবেন না। ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ বিমা কোম্পানির পরিচালক বা চেয়ারম্যানও হতে পারবেন না। আর পরিচালকের টানা মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ছয় বছর।

শাস্তি ও জরিমানা বৃদ্ধি

বিমা কোম্পানি মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে আইডিআরএ যাতে নতুন পলিসি বিক্রি বা প্রিমিয়াম নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে—এমন একটি নতুন ধারা যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যর্থতার জন্য জরিমানা হবে ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত। মূলধন ঘাটতি পূরণে দেরি হলে প্রতিদিনের জরিমানা হবে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা।

বর্তমানে সর্বনিম্ন জরিমানার অঙ্ক পাঁচ লাখ টাকা। সংশোধিত আইনে আর্থিক জরিমানাসহ সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা উভয় শাস্তির বিধানের কথা বলা হয়েছে।

মালিকপক্ষের মতামত

আইন সংশোধনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিমা কোম্পানির মালিকপক্ষের সমিতি বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি সাঈদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা বিআইএর সদস্যদের কাছে মতামত চেয়েছি। সব মতামত নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আইডিআরএকে জানাব। আমরাও চাই বিমা খাতের উন্নয়ন এবং এ জন্য আইন যুগোপযোগী হোক।’