আল মুস্তাসিম নবী নিকু : বিচার বিভাগ একটি দেশের সর্বোচ্চ ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠান। এটি গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রধানতম উপকরণ। তাই বিচার ব্যবস্থার কাঠামোগত যেকোনো পরিবর্তন অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং সুপরিকল্পিত হতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলা পর্যায়ে স্থায়ী আদালত স্থাপন এবং জেলা সদর থেকে বিচারিক কার্যক্রম স্থানান্তরের একটি প্রস্তাব আলোচনায় এসেছে।
সরকার পক্ষ একে ‘বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও—এই প্রস্তাব নিয়ে গভীর আইনগত, সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে: এটি কি সত্যিকারের বিকেন্দ্রীকরণ, নাকি ‘নতুন কেন্দ্রায়নের ছদ্মবেশে’ বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার জন্য এক নতুন ধরনের হুমকি?
প্রস্তাবের সারমর্ম
বিচার সংস্কার কমিশন সম্প্রতি সুপারিশ করেছে, প্রতি টি উপজেলায় প্রয়োজন অনুযায়ী দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে সিনিয়র সহকারী জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের পদায়ন, আর্থিক এখতিয়ার বৃদ্ধি, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও জনগণের নিকটবর্তী ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য বলা হয়েছে।
বিকেন্দ্রীকরণ না কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের পুনঃপ্রতিষ্ঠা?
বিকেন্দ্রীকরণের মূল দর্শন হলো—ক্ষমতা, দায়িত্ব ও সম্পদ স্থানীয় স্তরে হস্তান্তর করা, যাতে জনগণ সেবা পেতে আরও নিকটবর্তী হয়। তবে বর্তমান প্রস্তাবটি প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ নয়, বরং এটি প্রশাসনিক স্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ বিস্তারের নতুন কৌশল বলেই অনেকেই মনে করছেন।
❖ বাস্তব বিকেন্দ্রীকরণ মানে কী?
প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ তখনই কার্যকর হয়, যখন স্থানীয় স্তরের বিচার বিভাগীয় নিয়োগ, বাজেট, প্রশাসন ও প্রক্রিয়া সমূহ নিজস্বভাবে পরিচালিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচারকদের নিয়োগ, পদায়ন, বাজেট ও তদারকি আজও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন। উপজেলা পর্যায়ে আদালত চালু হলেও সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায়, যা বিচারিক কার্যক্রমকে রাজনৈতিক ও بيرোক্র্যাটিক চাপে ফেলতে পারে।
❖ বিচারক-পুলিশ-ইউএনও একই ছাদের নিচে?
একই উপজেলায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ এবং বিচার বিভাগীয় অফিস যদি ঘনিষ্ঠ কার্যসম্পর্কে পরিচালিত হয়, তাহলে ক্ষমতার ভারসাম্য ভেঙে পড়বে। যেখানে পুলিশ ও ইউএনও কার্যত নির্বাহী শাখার অন্তর্ভুক্ত, সেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাস্তবে হুমকির মুখে পড়তে পারে।
সাংবিধানিক ও কাঠামোগত দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের সংবিধানের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—”বিচার বিভাগের কার্যাবলি নির্বাহী বিভাগ হইতে পৃথক হইবে।” কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপনের ফলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রশাসনিক কর্তৃত্বের কারণে বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা থেকে যায়।
১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধঃস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির অধীনে থাকলেও, বাস্তবে এটি চলে মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শে, যার ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। এখন যদি সেই কাঠামো উপজেলা স্তরে নামিয়ে আনা হয়, তাহলে ক্ষমতার চর্চার কেন্দ্র আরও বেশি কেন্দ্রায়িত হয়ে পড়বে, নামমাত্র বিকেন্দ্রীকরণের নামে।
বাস্তব সমস্যাসমূহ ও প্রতিবন্ধকতা
১. অবকাঠামো ও মানবসম্পদের ঘাটতি : বিচারক, নাজির, পেশকার, আইনজীবী এবং নিরাপত্তাকর্মী—উপজেলা পর্যায়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ জনবল সরবরাহ এবং স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তোলা সহজ কাজ নয়। বর্তমানে অনেক জেলা আদালতেই কোর্টরুম সংকট বিদ্যমান; সেক্ষেত্রে উপজেলায় এই কাঠামো বাস্তবায়ন একটি বিশাল ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।
২. বিচার বিভাগের গুণগত মান ও পর্যবেক্ষণ সংকট : উপজেলা পর্যায়ে বিচারের মান নিরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো বা পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া প্রস্তাবে নেই। এর ফলে নিম্নমানের রায়, পক্ষপাতমূলক বিচার ও বিচারিক ভুল বাড়তে পারে।
৩. দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের বিস্তার : উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয় আরও ঘন। ফলে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা রক্ষায় এ পর্যায়ে দুর্নীতি, ভয়ভীতি, দলীয় প্রভাব বা সামাজিক চাপ বিচারকদের উপর পড়ার আশঙ্কা আরও তীব্র হতে পারে।
৪. জনগণের হয়রানি ও ব্যয় বৃদ্ধি : প্রকৃতপক্ষে, একটি অপর্যাপ্ত ও দুর্বল আদালত ব্যবস্থাপনা—উপজেলা পর্যায়ে বিচার প্রার্থীদের জন্য হয়রানির নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। বারবার তারিখ, স্থানান্তর, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, এবং পেশাগত দক্ষতার অভাবে বিচার প্রার্থীকে জেলা সদরের চেয়েও বেশি কষ্ট পেতে পারে।
জেলাভিত্তিক কাঠামোর শক্তিশালীকরণই বাস্তবসম্মত
বর্তমানে দেশে জেলাভিত্তিক বিচার কাঠামো প্রযুক্তির সহায়তায় আরও দক্ষভাবে পরিচালিত হতে পারে। ই-জুডিসিয়াল ব্যবস্থা, ভার্চুয়াল কোর্ট, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) এবং অনলাইন মামলার তদারকি—এসব পদ্ধতি দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে এবং দীর্ঘসূত্রিতা কমায়।
বিশেষ করে যেসব জায়গায় মামলা বেশি, সেখানে অতিরিক্ত কোর্ট স্থাপন, অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ এবং কার্যপ্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশন করলেই বিচারিক গতি ও মান অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট
বিভিন্ন মহলের মতে, বিচার বিভাগকে উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ও আদালতের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
নির্বাচনী এলাকায় বিচার বিভাগীয় প্রভাব বিস্তার এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে একত্রে ক্ষমতা কায়েমের সুযোগ থাকলে ‘বিচার’ হয়ে উঠবে ‘প্রশাসনিক সুবিধা’, যা গণতন্ত্রের জন্য ভয়ঙ্কর সংকেত।
সুপারিশ ও উপসংহার
বিচার ব্যবস্থাকে বাস্তব বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে শুধু কোর্টরুম বাড়ানো নয়—নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করাই বেশি ফলপ্রসূ হবে:
১. জেলা আদালতের অবকাঠামো ও জনবল বাড়ানো
২. ই-জুডিসিয়াল সেবা ও ভার্চুয়াল শুনানি শক্তিশালী করা
৩. ADR ব্যবস্থার বাধ্যতামূলক প্রয়োগ
৪. বিচারকদের প্রশিক্ষণ, নিরীক্ষা ও স্বাধীনতা নিশ্চিতে নতুন নীতিমালা
৫. উপজেলা পর্যায়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে আইনগত রক্ষাকবচ যুক্ত করা
পরিশেষে বলা যায়, “বিকেন্দ্রীকরণ” শব্দটি যদি শুধু ‘ভৌগোলিক ছড়িয়ে দেওয়া’র মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা বিভ্রান্তিমূলক সংস্কারে পরিণত হবে। বিচার ব্যবস্থার গুণগত বিকাশ, স্বাধীনতা ও প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকেই হওয়া উচিত সংস্কারের মূল লক্ষ্য।
লেখক : আল মুস্তাসিম নবী নিকু; অ্যাডভোকেট, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট । ই-মেইল: almustashimnobi.niku@gmail.com