তথ্য গোপন করে বৈধ বিয়ে—ধর্মীয়, আইনগত ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্বামীর প্রতিকার
আল মুস্তাসিম নবী নিকু

চেক উদ্ধারে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৮ ধারার প্রয়োগ: আইনি ব্যাখ্যা ও বাস্তবতা

আল মুস্তাসিম নবী নিকু : বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে চেক লেনদেন একটি অপরিহার্য ও প্রচলিত মাধ্যম। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এনজিও কিংবা কর্পোরেট লেনদেন—প্রত্যেক ক্ষেত্রেই চেক একটি আস্থাভিত্তিক আর্থিক দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আস্থাভিত্তিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রতারণার আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে, স্বাক্ষরিত সাদা চেক কৌশলে আদায় করে বা প্রতারণার মাধ্যমে কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

প্রতারণার মাধ্যমে এই চেক গোপনে ব্যবহার করে মূল মালিকের আর্থিক ক্ষতিসাধনের ঘটনা নিত্যদিনই ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে শুধু দেওয়ানি মামলা কিংবা ১৩৮ ধারার অধীনে চেক ডিজঅনার মামলাও যথেষ্ট প্রতিকার দিতে ব্যর্থ হয়। জরুরি ভিত্তিতে চেক উদ্ধার এবং তা আদালতের জিম্মায় নেওয়া একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এখানে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৯৮ ধারা একটি কার্যকর ও প্রাসঙ্গিক আইনি হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়।

৯৮ ধারার পাঠ ও আইনি কাঠামো

ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৯৮ ধারা মূলতঃ অবৈধ বস্তু, জাল দলিল, চোরাই মাল, অথবা অশ্লীল সামগ্রী উদ্ধারে তল্লাশি পরোয়ানা জারি সংক্রান্ত বিধান।

তবে আদালতের ব্যাখ্যামূলক প্রয়োগে এই ধারা মূল্যবান অর্থনৈতিক দলিল যেমন—চেক উদ্ধারের ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

ধারার পাঠ:

৯৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অনুসন্ধানের মাধ্যমে সন্তুষ্ট হন যে কোনো স্থানে—

  • চোরাই মাল বিক্রয় বা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে;

  • অথবা সেখানে জাল দলিল, স্ট্যাম্প, সীল বা সেগুলোর প্রস্তুতি সামগ্রী রয়েছে;

  • অথবা অশ্লীল বস্তু মজুদ বা উৎপাদন হচ্ছে;

তাহলে তিনি তল্লাশি পরোয়ানা ইস্যু করে সংশ্লিষ্ট জায়গায় তল্লাশি ও জব্দের নির্দেশ দিতে পারেন।

৯৮(২) উপধারায় জাল কয়েন, মেটাল টোকেন, কিংবা টোকেন প্রস্তুতির উপকরণ সম্পর্কেও নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে।

চেক উদ্ধারের ক্ষেত্রে ৯৮ ধারার প্রাসঙ্গিকতা

চেক একটি আইনসম্মত অর্থনৈতিক দলিল (Negotiable Instrument) এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ও চেক আইন অনুযায়ী চেক প্রতারণা বা জালিয়াতি একটি ফৌজদারি অপরাধ।

যখন কোনো ব্যক্তি চেকটি—

  • প্রতারণা বাবদ প্রয়োগ করে আদায় করে;

  • প্রকৃত মালিকের সম্মতি ছাড়া দখলে রেখে দেয়;

  • অথবা মালিকের অজ্ঞাতে বা অনুমতি ব্যতীত কাজে লাগানোর চেষ্টা করে—

তখন সেটিকে ‘অবৈধ দখল’ হিসেবে গণ্য করা যায়।

এই প্রেক্ষাপটে, যদি চেকটি কোনো অফিস, বাসা, দোকান বা প্রতিষ্ঠানে গোপনে সংরক্ষিত থাকে এবং সেই চেকের অবৈধ ব্যবহারে মালিকের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে—

তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৮ ধারার অনুসারে সেই চেক উদ্ধার করা সম্ভব।

ব্যবহারিক বাস্তবতা ও উদাহরণ

ঘটনা-১:

জনৈক ব্যক্তি একটি এনজিওতে চাকরি করতেন। চাকরি ত্যাগের সময় কর্তৃপক্ষ তার প্রভিডেন্ট ফান্ড বুঝিয়ে না দিয়ে জোর করে একটি সাদা চেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়।

পরে সেই চেক তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহারের হুমকি দেওয়া হয়।

তখন তিনি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ৯৮ ধারায় আবেদন করেন।

আদালত অভিযোগকারীর বক্তব্য যাচাই করে, তল্লাশি পরোয়ানা জারি করে সংশ্লিষ্ট অফিসে তল্লাশি চালিয়ে সেই চেক উদ্ধার করেন এবং আদালতের হেফাজতে রাখেন।

ঘটনা-২:

এক ব্যবসায়িক চুক্তির অংশ হিসেবে জনৈক ব্যবসায়ী একটি পোস্ট-ডেটেড চেক দেন।

পরবর্তীতে চুক্তিটি বাতিল হলেও অপর পক্ষ চেকটি ফেরত না দিয়ে তা জমা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

এখানে চেকের মালিক ৯৮ ধারার আশ্রয় নেন এবং বলেন:

“চেকটি অবৈধভাবে আটকে রাখা হয়েছে এবং এর অপব্যবহার হতে পারে।”

ম্যাজিস্ট্রেট প্রাথমিক সত্যতা যাচাই করে পরোয়ানা ইস্যু করেন এবং পুলিশ চেকটি উদ্ধার করে আদালতের কাছে হস্তান্তর করে।

আইনি প্রতিকার ও বিস্তার

এই ধারার প্রয়োগের মাধ্যমে কেবল চেক উদ্ধারই নয়, বরং এর অপব্যবহার রোধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া সম্ভব।

উদ্ধারকৃত চেক আদালতের জিম্মায় থাকলে:

  • অপর পক্ষ আর তা অবৈধভাবে ব্যবহার করতে পারে না;

  • ভবিষ্যতে এই চেক মামলার আলামত হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে;

  • এবং প্রকৃত মালিক আদালতের মাধ্যমে চেক ফেরত পেতে পারেন।

সতর্কতা ও বিচারিক চ্যালেঞ্জ

৯৮ ধারায় আবেদন করার সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে:

  • বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ: শুধুমাত্র অনুমান নয়, প্রাথমিক প্রমাণাদি থাকতে হবে।

  • চেকের অস্তিত্ব ও অবস্থান নির্দিষ্ট করে বলা: কোথায় চেকটি আছে, কার কাছে আছে—এই তথ্য সুনির্দিষ্ট হতে হবে।

  • তৎকালীন ক্ষতির আশঙ্কা: চেক ব্যবহার হলে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, তা আদালতকে বুঝাতে হবে।

  • ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টি: আদালতকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে সন্তুষ্ট করতে হবে যে এই পদক্ষেপ ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন।

আদালতের ব্যাখ্যামূলক ভূমিকা

আইনের ব্যাখ্যায় বিচারকগণ একটি মূলনীতিতে বিশ্বাস করেন:

“Where the text is silent, the spirit speaks.”

অর্থাৎ, আইন কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু না বললেও, বিচারিক উদ্দেশ্য পূরণে তার উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন অনুসারে ব্যাখ্যার অধিকার আদালতের আছে।

এই ব্যাখ্যাত্মক ক্ষমতা ব্যবহার করেই বহু নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চেক উদ্ধারে ৯৮ ধারার প্রয়োগ করেছেন।

বিচারিক দৃষ্টান্ত ও পূর্বাপর প্রয়োগ

বাংলাদেশের নিম্ন আদালতসমূহে ইতিপূর্বে এমন বহু মামলা হয়েছে যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চেক উদ্ধারে ৯৮ ধারা প্রয়োগ করেছেন।

যদিও আপিল বিভাগ বা হাইকোর্ট বিভাগে এখনো এই প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের কোনো ব্যাখ্যামূলক রায় খুব বেশি নেই, তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ নিয়মিতভাবে এই ধারা প্রয়োগ করে আসছেন।

বিশেষ করে চেক উদ্ধারের জন্য যে ধরনের অবিলম্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন, সেখানে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৮ ধারা-ই সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এটি একাধারে প্রতিকারমূলক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।

আইনি ও সামাজিক গুরুত্ব

চেক উদ্ধারের জন্য ৯৮ ধারার প্রযোজ্যতা কেবল ব্যক্তি অধিকার রক্ষার জন্য নয়, বরং বৃহত্তর ব্যাংকিং ও আর্থিক নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

একজন ব্যক্তি যখন প্রতারণার মাধ্যমে চেক হারান, তখন শুধুমাত্র তার আর্থিক ক্ষতি হয় না—বরং চেকটি অন্য কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হলে তিনিই ফৌজদারি দায়ে জড়াতে পারেন।

ফলে দ্রুত চেক উদ্ধার করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

৯৮ ধারায় যে প্রক্রিয়া নির্ধারিত রয়েছে, তা আইন, প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে সুনির্দিষ্ট, নিরাপদ ও জবাবদিহিমূলক।

ম্যাজিস্ট্রেট চেক জব্দ করে তা আদালতের জিম্মায় রাখলে তা আর কেউ অপব্যবহার করতে পারে না এবং আসল মালিক পরবর্তীতে আদালতের মাধ্যমে তা ফেরত পাওয়ার সুযোগ পায়।

আইনজীবীদের ভূমিকা

আইনজীবীদের উচিত:

  • ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য নিয়ে, প্রমাণ-সহায়ক অভিযোগ তৈরি করা;

  • চেকের অস্তিত্ব, দখল ও সম্ভাব্য ক্ষতির যুক্তিযুক্ত ভিত্তি তুলে ধরা;

  • আদালতকে বুঝাতে সক্ষম হওয়া কেন ৯৮ ধারার প্রয়োগ ন্যায়বিচারের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়।

পরিশেষে বলা যেতে পারে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৮ ধারা মূলত একটি প্রতিকারমুখী ও প্রতিরোধমূলক বিধান, যা ইতিহাসগতভাবে চোরাই মাল ও জাল বস্তু উদ্ধারে ব্যবহৃত হলেও—আধুনিক আর্থিক জালিয়াতির প্রেক্ষাপটে এর ব্যবহারিক পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে।

বিশেষ করে চেকের মতো মূল্যবান ও স্পর্শকাতর দলিল যদি বেআইনি ভাবে আটক বা কুক্ষিগত হয়, তাহলে এই ধারা তার উদ্ধার, সংরক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি কার্যকর হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

চেক লেনদেনে আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৮ ধারা একটি প্রাসঙ্গিক ও শক্তিশালী আইনি সংস্থান, যার যথাযথ প্রয়োগ আইনজীবী, বিচারক এবং সাধারণ নাগরিকদের সম্মিলিত সচেতনতা ও দায়িত্বের মাধ্যমেই সম্ভব।

লেখক : আল মুস্তাসিম নবী নিকু; অ্যাডভোকেট, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট। ই-মেইল: almustashimnobi.niku@gmail.com