সিরাজ প্রামাণিক : সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক গ্রেফতার হয়েছে। সংবাদটি টক অব দ্যা কান্ট্রি। বুঝে কিংবা না বুঝে হুজুগে বাঙালী নানান জনের নানান মত প্রকাশ হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারলাম বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ীতে যুবদল নেতা হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। একথা বিশ্বাস করার মোটেই কারণ নেই যে, এ বি এম খায়রুল হক যাত্রাবাড়ীতে যুবদল নেতা হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। সরকার প্রধানও জানেন মামলাটি মিথ্যা। আইন, আদালত, ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করার এটা একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণও মাত্র।
শিশু থেকে বৃদ্ধ পুরো দেশবাসী জানেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতির লেখা একটা রায়ে বাংলাদেশ এক গভীর সংকটে পতিত হয়েছিলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল। শুধু তাই নয়, আরও অনেকগুলো বিতর্কিত রায় রয়েছে। যেগুলো নিয়ে আলোচনা করলে লেখাটি নাতিদীর্ঘ হয়ে যাবে। শুধু এতটুকু বলি সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের তোয়াক্কা না করে তিনি এমন একটি রায় দিয়েছেন যার ফলে রাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিস এক দীর্ঘ সংকটে পতিত হয়েছে। যার ফলাফল এখনও এই রাষ্ট্রকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
ওনি যে অপরাধ করেছেন, তার জন্য যুবদল হত্যা মামলার আসামী নয়, তিনি হবেন দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে আইন বিরুদ্ধ রায় দেয়ার অপরাধে আসামী। আইন অনুযায়ী তিনি দন্ডবিধির ২১৯ এবং ৪৬৬ ধারার সুস্পষ্ট অপরাধ করেছেন। এ দুটি ধারার মধ্যে দন্ডবিধি’র ২১৯ ধারা বলছেন
একজন পাবলিক সার্ভেন্ট কর্তৃক বিচারিক কার্যক্রমের যেকোনো পর্যায়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে আইন বিরুদ্ধ কোনো রায় বা সিদ্ধান্ত দিলে তবে তিনি ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
মনে রাখবেন, প্রত্যেক বিচারকই কিন্তু পাবলিক সার্ভেন্ট। দন্ডবিধির ২১ ধারায় পাবলিক সার্ভেন্ট এর সংজ্ঞা পড়লেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটা গুরুতর অভিযোগ হলো তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ পরবর্তীতে আংশিক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন যা দন্ডবিধির ৪৬৬ ধারার অপরাধ। এ ধারায় বলা আছে,
কেউ আদালতের রায় জালিয়াতি করলে তার শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং একইসাথে অর্থদন্ডেরও বিধান আছে।
আরও পড়ুন : রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারলাম, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কারাগারে আটক রাখার শুনানিতে আদালতকে অসহযোগিতা করায় ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) তারেক জুবায়েরের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে।
আদালতের আদেশে বলা হয়েছে- আসামি সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে ২৪ জুলাই গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে আদালতে হাজির করা হবে বলে ডিসি প্রসিকিউশন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান। এরপর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটির শুনানির জন্য অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ছানাউল্ল্যাহকে দায়িত্ব দেন।
পরে মামলার শুনানির অপেক্ষায় থাকা বিচারককে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে ডিসি (অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগ) তারেক জুবায়ের ফোন করে বলেন, আসামিকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের নিচে প্রিজনভ্যানে রাখা হয়েছে এবং সেখান থেকেই শুনানি নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। বিচারক আদালতের ভাবমূর্তি রক্ষা ও বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ না করার স্বার্থে ডিসির এ প্রস্তাবে রাজি হননি।
আদেশে আরও বলা হয়, আসামিকে আদালতে হাজির করতে দেরি হওয়ায় বিচারক দায়িত্বের অংশ হিসেবে সন্ধ্যা ৭টা ১৪ মিনিটে ডিসি তারেক জুবায়েরকে ফোন করে জানতে চান, আসামিকে হাজির করতে কত সময় লাগতে পারে। জবাবে ডিসি তা বলতে পারবেন না বলে মতপ্রকাশ করেন। এরপর বিচারক আনুমানিক সময় জানতে চাইলে ডিসি তাও জানাতে রাজি হননি এবং তিনি এ বিষয়ে বিচারকের সঙ্গে কথা বলতে বা কোনো তথ্য দিতে আগ্রহী নন। বরং তিনি আইন উপদেষ্টা ও ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
আদালত বলেন, ডিএমপির অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি, বিচারিক কার্যক্রম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে মামলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান, যা ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যের পরিচয়।
আদালত আরও বলেন, ডিসি প্রসিকিউশনের এমন আচরণ পুলিশ প্রবিধান ও প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করে এবং তার এই অসহযোগিতা দণ্ডবিধির ১৭৬, ১৭৯ ও ২২৮ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়ে। এছাড়া বিচারক যেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫ ধারার আওতায় ‘এক্স-অফিসিও জাস্টিস অব পিস’ এবং বিচারিক দায়িত্বে ছিলেন, তাই তার জিজ্ঞাসিত বিষয়ে তথ্য না দিয়ে সহযোগিতা না করাটা আদালত অবমাননার শামিল।
আরও পড়ুন : আইআইইউসি’র আইন বিভাগে প্রভাষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
আদেশে আদালত বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার এ কর্মকাণ্ডের জন্য তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার জন্য প্রসিডিং (বিচারিক কার্যধারা) গ্রহণের নিমিত্তে বিষয়টি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপনের জন্য কেন প্রেরণ করা হবে না- সেই মর্মে আগামী ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য ডিসি তারেক জুবায়েরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিসন্দেহে সাহসী ও আইনগত আদেশ।
পাঠক, নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে পুলিশ প্রধান শাহাদুল হকের চাকরিচ্যুতির গল্পের কথা। সেই ২০০৩ সালের ১৯ জুন। আইজি তার জবাবে বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতে কটূক্তি করেন। জবাব আমলে নিয়ে বিচারপতি মো. আবদুুল মতিন এবং বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহম্মেদ স্বপ্রণোদিতভাবে আইজিপির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করেন। একই সঙ্গে আইজিপিকে স্বশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। হাইকোর্ট ডিভিশন আইজিপিসহ চারজন পুলিশ অফিসারের জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা প্রদান করেন।
হাইকোর্ট ডিভিশনের আদেশের পরে দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা অভিমত দেন, দ্য পাবলিক সার্ভেন্ট অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৫ অনুযায়ী পুলিশ প্রধানের চাকরিতে থাকার সুযোগ নেই। রায় প্রদানের সময় আইজিপি ফ্রান্সে ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে ছিলেন একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সে যখন দেশে আসেন সে সময় তাকে বিমানবন্দরে পুলিশ প্রধান হিসেবে প্রোটোকল দেওয়া হয়নি। তাকে সাময়িক পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ডিএমপির কমিশনারকে চার্জে রাখা হয়। পরে সাসপেন্ড করা হয়। হাইকোর্ট ডিভিশন এ রায়ে জুডিশিয়ারির মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবজারভেশন প্রদান করেন।
হাইকোর্ট ডিভিশন সুস্পষ্টভাবে বলে, সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুলিশসহ নির্বাহী বিভাগ আদালতকে সহায়তা করতে বাধ্য। তাছাড়া আদালত বলতে শুধু গম্বুজাকৃতির বিল্ডিংকেই বোঝাবে না, বরং ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫ ধারা অনুয়ায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির এখতিয়ার সমগ্র বাংলাদেশ। সমগ্র বাংলাদেশেই এখতিয়ার প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে।
আরও পড়ুন : বিচারিক কাজে অসহযোগিতায় ডিসি তারেক জুবায়েরকে ব্যাখ্যার নির্দেশ
একটি ছোট্ট কেস স্টাডি দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। ১৯৪৮-৪৯ সালের ঘটনা। আপনারা নিশ্চয়ই তৎকালীন বিশিষ্ট রাজনীতিক মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর নাম শুনে থাকবেন। একজন আদর্শ রাজনীতিক হিসেবে এ উপমহাদেশে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
একদা স্থানীয় এমএলএ মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ তার এলাকা পাবনায় গেলে সরকারী প্রকৌশলীর বাসভবনে স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে বসেন।
ধর্মপ্রাণ মাওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজ শেষে সবার সাথে চা পানের ফাঁকে ওই বৈঠকে হাজির সাব ডিভিশনাল মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজ) কে একটা চলমান দেওয়ানী মামলা খারিজ করে দেয়ার জন্য বলেন। স্থানীয় এমএলএর এহেন কাজ বিচারকাজে মারাত্মক হস্তক্ষেপ উল্লেখে মুন্সেফ সাহেব মাননীয় জেলা জজের মাধ্যমে ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ করলেন। এর প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সাহেবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করেন।
অভিযুক্ত তার আইনজীবী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ আদালতে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেকে আদালতের দয়ার উপর ছেড়ে দেন। শেরে এ বাংলা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর মহান অবদান আর ধর্মনিষ্ঠ রাজনীতিকের আইনের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধার কথা জানিয়ে অভিযুক্তকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য নিবেদন করেন।
বিচারপতি ইলিস রীতিরকম মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর এরকম দুঃখ প্রকাশকে গ্রহণ না করে যাতে ভবিষ্যতে কেউ আদালতের কাজে হস্তক্ষেপ না করে সে বিবেচনায় মাওলানাকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে পাঁচশ রুপি জরিমানা অনাদায়ে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেন। (১ ডিএলআর ১৭৮ পৃষ্ঠা)।
বিচারকদের প্রতি আকুল আবেদন, বুকে সাহস নিয়ে এরকম সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিচার বিভাগের পুনরায় আস্থা ফিরিয়ে আনুন। সকল পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, পিএইচ. ডি গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইল : seraj.pramanik@gmail.com