আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়

আইন ও বিচার বিভাগের পদায়ন বিধিমালার গেজেট প্রকাশ

বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় প্রশাসনে যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ হিসেবে ‘আইন ও বিচার বিভাগের পদায়ন বিধিমালা, ২০২৫’ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। এই বিধিমালার মাধ্যমে বিচারকদের প্রশাসনিক পদে পদায়নের ক্ষেত্রে আইনত একটি কাঠামোগত ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা পেল। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সোমবার (২৮ জুলাই) এটি জারি করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়

এই বিধিমালা বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা, পেশাগত অগ্রগতি ও সাংবিধানিক ভারসাম্যের এক বাস্তবায়ন—যার ভিত্তি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০০৮ সালের রায়।

গেজেটে বলা হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের ১১১/২০০৮ ও ১১২/২০০৮ নম্বর সিভিল আপিলে প্রদত্ত রায়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন সচিব পদসহ অন্যান্য পদে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের নিয়োগের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রয়েছে; এবং যেহেতু আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব পদসহ বিভিন্ন পদে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের নিয়োগ করা হয়; সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে এই বিধিমালা প্রণয়ন করেন।

বিধিমালার ৪(১) ধারায় নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার তালিকা দেওয়া হয়েছে, যেখানে জেলা ও দায়রা জজ পদে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে সহকারী জজের জন্য ৩ বছরের অভিজ্ঞতা ও স্থায়ীকরণের শর্ত উল্লেখ রয়েছে।

তবে বিধিমালায় সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত ২৫% পদে জুডিশিয়াল সার্ভিস বহির্ভূত ব্যক্তিদেরও নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে, তবে তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে আইন ও বিচার বিভাগের সম্মতি নিয়ে করতে হবে।

এই বিধিমালা কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২০০১ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করা হয়েছে এবং আগের বিধির অধীনে গৃহীত পদক্ষেপসমূহও বৈধ বলে বিবেচিত হবে।

নতুন বিধিমালার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো:

  • বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা আইন সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সহকারী সচিব ইত্যাদি পদে নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদায়ন পাবেন।

  • সহকারী সচিব থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং যোগ্যতা নির্ধারণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ তফসিল সংযুক্ত করা হয়েছে।

  • ২৫ শতাংশ পদে জুডিশিয়াল সার্ভিসের বাইরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগযোগ্য থাকলেও, সে ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে আইন ও বিচার বিভাগের সম্মতি নিতে হবে।

  • অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে নিয়োগ হবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে।

পূর্ববর্তী নীতিমালার রহিতকরণ

বিধিমালার ১(২) ধারা অনুযায়ী, এটি “বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের পদায়ন সংক্রান্ত বিধান” হিসেবে বলবৎ হবে।

এটি ২০০১ সালের “আইন ও বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১ম শ্রেণির পদে নিয়োগ নীতিমালা” রহিত করে। তবে পূর্ববর্তী নীতিমালার আওতায় গৃহীত কার্যক্রমগুলো বৈধ বলে বিবেচিত হবে।

এ পদক্ষেপের ফলে প্রশাসনে বিচারকদের সংযুক্তি এখন থেকে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হবে, যা জবাবদিহি ও পেশাগত মানদণ্ড নিশ্চিত করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পদসমূহ যেখানে জুডিশিয়াল সার্ভিসের কর্মকর্তারা পদায়িত হতে পারবেন

বিধিমালার ৪ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যগণ নিম্নোক্ত প্রশাসনিক পদে পদায়িত হতে পারবেন:

  • আইন সচিব

  • অতিরিক্ত সচিব

  • যুগ্ম সচিব/সলিসিটর

  • উপসচিব/উপসলিসিটর

  • সিনিয়র সহকারী সচিব

  • সহকারী সচিব

নিয়োগ বা পদায়নের নিয়ম ও কর্তৃপক্ষ

বিধিমালার ৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে: এই বিধিমালা অনুসারে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের মধ্য হইতে সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, উপসলিসিটর, যুগ্মসচিব, সলিসিটর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন ও বিচার বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করবে।

বিধিমালার ৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে: অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাথে পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে আইন ও বিচার বিভাগ প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করবে।

২৫% পদে প্রশাসনিক ক্যাডারের সুযোগ: কিন্তু শর্তসাপেক্ষে

বিধিমালার ৬ ধারায় বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পদসমূহের ৭৫% জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত, বাকি ২৫% পদে প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে কর্মকর্তাদের পদায়নের সুযোগ থাকবে, তবে সে ক্ষেত্রে আইন ও বিচার বিভাগের সম্মতি গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।

যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা: কত বছরের চাকরি হলে কোন পদে যাওয়া যাবে

বিধিমালার তফসিল অংশে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে কে কোন পদে কত বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যোগ্য হবেন:

সচিব

নিয়োগ পদ্ধতি: অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত সার্ভিস সদস্যদের মধ্য হতে বদলি বা নিয়োগের মাধ্যমে।

যোগ্যতা: জেলা ও দায়রা জজ/সমপর্যায়ের পদে ৫ বছর এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে ন্যূনতম ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা

অতিরিক্ত সচিব

নিয়োগ পদ্ধতি: জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ের পদে কর্মরতদের মধ্য হতে বদলি বা নিয়োগ।

যোগ্যতা: জেলা ও দায়রা জজ/সমপর্যায়ের পদে কাজের অভিজ্ঞতাসহ জুডিশিয়াল সার্ভিসে অন্তত ২১ বছরের অভিজ্ঞতা।

যুগ্মসচিব / সলিসিটর

নিয়োগ পদ্ধতি: অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ের সদস্যদের মধ্য থেকে।

যোগ্যতা: জুডিশিয়াল সার্ভিসে ন্যূনতম ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পদে অন্তত ৩ বছরের কার্যকাল।

উপসচিব / উপসলিসিটর

নিয়োগ পদ্ধতি: যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্য হতে।

যোগ্যতা: জুডিশিয়াল সার্ভিসে অন্যূন ১০ বছরের অভিজ্ঞতা।

সিনিয়র সহকারী সচিব

নিয়োগ পদ্ধতি: সিনিয়র সহকারী জজদের মধ্য হতে।

যোগ্যতা: জুডিশিয়াল সার্ভিসে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা

সহকারী সচিব

নিয়োগ পদ্ধতি: সহকারী জজ পর্যায়ের স্থায়ীকৃত সদস্যদের মধ্য হতে।

যোগ্যতা: কমপক্ষে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সহকারী জজ পদে স্থায়ী হওয়া বাধ্যতামূলক।

এছাড়াও প্রতি স্তরে প্রার্থীর যোগ্যতা, সততা, দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া হবে।

বিচার বিভাগের অভ্যন্তরে সমন্বয় বাড়াবে নতুন বিধিমালা

এই বিধিমালা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০০৮ সালের রায় অনুযায়ী আইন ও বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার একটি পদক্ষেপ। এতে করে প্রশাসনের উচ্চপদে বিচারকদের পদায়ন এখন আর রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক বিবেচনায় নয়, বরং স্পষ্ট আইনানুগ কাঠামোর মধ্যে দিয়ে হবে।

বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই বিধিমালা আইনি জবাবদিহিতা, পেশাগত মর্যাদা ও বিচার বিভাগের প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়াবে। দীর্ঘদিন ধরে বিচারকদের প্রশাসনিক পদে পদায়নে স্বচ্ছ ও বৈধ কাঠামো অনুপস্থিত ছিল—এই বিধিমালায় সেই ঘাটতি পূরণ হয়েছে।

‘আইন ও বিচার বিভাগের পদায়ন বিধিমালা, ২০২৫’ একটি যুগান্তকারী ও কাঠামোগত উদ্যোগ। এটি শুধু প্রশাসনিক কার্যকারিতা নয়, বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা ও সংবিধানসম্মত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।