মো. তানভীর আহমেদ
মো. তানভীর আহমেদ

আমার দেখা গণঅভ্যূত্থান ও ৩১ জুলাইয়ের “March for Justice”

মোঃ তানভীর আহমেদ : আবু সাঈদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মনে এক অজানা অস্থিরতা শুরু হয়। এরপর একে একে শিক্ষার্থী হত্যা দেখতে দেখতে রাতে ঘুম হারাম হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মমতা এবং নির্বিচারে গুলি চালনার ঘটনায় পুরো জাতি স্তব্ধ হয়ে পড়ে।
এর মধ্যেই দেখা যায়, জাতিসংঘের লোগোযুক্ত সামরিক যান ব্যবহার করা হচ্ছে সাধারণ ছাত্রজনতার বিরুদ্ধে। সেই মুহূর্তে, একজন আইনজীবী হিসেবে সরাসরি জাতিসংঘের বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা, সেটা নিয়ে কিছু সহকর্মীর সঙ্গে পরামর্শ শুরু করি, যাতে আন্তর্জাতিক মহলের নজর কাড়ে ও সরকারের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধের চাপ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে—নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড বাড়তে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে জনস্বার্থে গুলি বন্ধ ও শিক্ষার্থী সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তির দাবিতে একটি রিট দায়ের করা হয়। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে, ফলে জাতিসংঘকে বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ থেকে আমি সরে আসি।
২০ জুলাইয়ের পর থেকে সুপ্রীম কোর্ট এলাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে। সরকার কার্যত সারাদেশ  ব্ল্যাকআউট করে দেয়, যার কারণে আইনজীবীরাও প্রয়োজন ছাড়া কোর্টে আসতেন না। সরকার কারফিউ ঘোষণা দেয়, তবে আইনজীবীদের জন্য কারফিউ কিছুটা শিথিল থাকায় আমি প্রতিদিনই সুপ্রীম কোর্টে যেতাম দেশের পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে।
৩১ জুলাই ছাত্ররা ভার্চুয়ালি “March for Justice” কর্মসূচির পালন করার ঘোষণা দেয় । একই দিনে, অর্থাৎ ৩১ জুলাইয় গুলি চালানো বন্ধে জনস্বার্থে  রিটের শুনানির দিন নির্ধারিত ছিল। সকাল সকাল হাইকোর্টের দিকে রওনা দিই। পথে থমথমে পরিবেশ। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কোর্টের মধ্যে ঢুকি। আবেদনকারীদের পক্ষে খুব কম আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন, বিপরীতে রাষ্ট্রপক্ষ ও আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা পুরো শক্তিতে হাজির।
আদালত বসার আগেই তারা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। এক আওয়ামী পন্থী আইনজীবী আবেদনকারী আইনজীবীদের লক্ষ্য করে বলেই বসেন—“এত বড় সাহস! কলিজা টেনে চিবায়া খাব।” এরপর বিচারপতি আসেন এবং শুনানি শুরুর পূর্বেই আওয়ামী আইনজীবীদের চেঁচামেচি শুরু হয়। জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বিরক্ত হয়ে বলেন, “আপনারা থামুন, আমি ছাত্র জীবন আপনাদের থেকে কম রাজনীতি করি নাই, আমি আপনাদের থেকেও বড় ছাত্রলীগ ছিলাম।” পরবর্তীতে পরিবেশ কিছুটা ঠান্ডা হয়।
এরপর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন ও ব্যারিস্টার অনিক আর হক আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে কোর্ট আদেশ দেন। তবে আমার মতে, রাষ্ট্রপক্ষ পরে আদালতের আদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে এবং সেটাই বেশি প্রচার পায়।
আদালত থেকে বেরিয়ে অ্যাডভোকেট লিপি আপা (বর্তমান বিচারপতি) ও সারা আপার সঙ্গে আমি বলি, ছাত্ররা “March for Justice” একটি প্রোগ্রাম দিয়েছে, তাদের রক্ষার জন্য আমাদের যাওয়া উচিত। সারা আপা বলেন, যেহেতু তিনি জাতীয় তদন্ত কমিটির সদস্য, তার যাওয়া উচিত হবে না। লিপি আপা বলেন, “আমরা সাধারণ আইনজীবীরা যাই।”
এরপর সময়মতো লিপি আপার চেম্বারের সামনে আমি, আমার বন্ধু অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু  সাঈদ হাজির হই, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল মতিন এবং অ্যাডভোকেট বাবরও আসেন। ঠিক তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন রনি আমাকে বলেন, “ভাই, আমি কি আপনাদের সাথে যেতে পারি ?” আমি বলি, “অবশ্যই, চলো।”
আমরা হাইকোর্টের মাজার গেটের দিকে যাই। পথে অ্যাডভোকেট শিউলি আপাকে দেখি ফিরে আসছেন। তিনি বলেন, “অনেক পুলিশ অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে, কয়েকজন ছাত্রকে ধরে নিয়ে গেছে।” আমরা তাকে আবার আমাদের সঙ্গে নিয়ে মাজার গেটে আসি, একটি কথা বলার প্রাসঙ্গিক যে, শিউলি আপা যাকে আইনজীবীদের মধ্যে প্রথম আমি আহত হতে দেখেছি তার আঙ্গুল ফুলে গিয়েছিল, গেটের বাইরে আসলেই পুলিশ গেট বন্ধ করে দেয়। বাইরে তখন আমরা হাতে গোনা কয়েকজন আইনজীবী।
মাজার গেটের বাইরে দেখি, এক ছোট্ট মেয়েকে সকল গণমাধ্যম ঘিরে রেখেছে এবং সে একাই সকলের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, কথা বলছে, পরবর্তীতে জেনেছি তার নাম নুসরাত স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ালেখা করছে। তাকে জিজ্ঞেস করি, “তোমার বন্ধুরা কোথায়?” সে বলে, “কয়েকজনকে ধরে নিয়েছে, কয়েকজন আশেপাশে।” আমি বলি, “ওদের ডাকো।” সে ডাক দিলে কয়েকজন ছাত্র আসে, এবং তারা সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিবাদ শুরু করে।
এক মহিলা পুলিশ অফিসার নুসরাতের হাত ধরে এবং আটক করতে চাই, আমরা প্রতিবাদ করি, তিনি তাকে ছেড়ে দেয়। এরপর দেখি, পুলিশ ভ্যানে একটি ছাত্রকে বসিয়ে রেখেছে, মহিউদ্দিন রনি বলে ভাই আমি ছাড়িয়ে নিয়ে আসবো পুলিশের গাড়ি থেকে, আমি বলি “থামো, পারবে না।” তার কিছুক্ষণ পর ছাত্রটিকে পুলিশ নিয়ে যেতে চাইলে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না—গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যাই।
একে একে মঞ্জুরুল মতিন, সাঈদ, বাবরসহ আমরা কয়েকজন আইনজীবী গাড়ির সামনে দাঁড়াই। আমরা গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখতে চাই এবং গাড়িটি যেতে বাধা প্রদান করি, একপর্যায়ে সামনে থাকা অফিসার ড্রাইভারকে বলে “চালিয়ে দাও” অর্থাৎ আমাদের উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার কথা বলে, আমরা বলি চালালে আমাদের উপর দিয়েই চালাতে হবে, পুলিশের ড্রাইভার কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।
এর মধ্যেই সুপ্রীম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আরও আইনজীবী হাজির হন।  পরবর্তীতে পুলিশ  ছাত্রটিকে ছাড়তে বাধ্য হয়। ইতিমধ্যে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা গেট খুলে বাইরে আসেন, কেউ কেউ লাফিয়ে। এসময় বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্ররা মাজার গেটে এসে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করে। পরবর্তীতে ছাত্রছাত্রী এবং আইনজীবীরা কোর্ট প্রাঙ্গণের মধ্যে চলে আসে।
একটি বিষয় না বললেই নয়—আমি যতটুকু দেখেছি, সেদিন মহিউদ্দিন রনি ছাড়া সকল ছাত্র-ছাত্রীই ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের।
হ্যাঁ, এটা সত্য যে, “March for Justice” কর্মসূচিতে সুপ্রীম কোর্ট এলাকায় খুব কম ছাত্র উপস্থিত হতে পেরেছিল। কিন্তু যে কজন ছিল, এবং আইনজীবীদের সক্রিয় সহযোগিতা—এই মিলিত প্রতিরোধ পুরো দেশে প্রভাব ফেলেছিল। এই দিনের পর থেকেই মানুষ বুঝতে শুরু করে, স্বৈরাচারী সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এই কারণেই ২ আগস্ট, সামাজিক মাধ্যমে আমি বলেছিলাম—“এক একটি ছাত্রের সাহস, যেন এক একটি নিউক্লিয়ার বোমা।”
লেখক : আইনজীবী ; বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।