সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনি নোটিশ
সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (ফাইল ছবি)

খায়রুল হকের গ্রেপ্তারে উদ্বেগ, প্রধান বিচারপতির কাছে খোলা চিঠি

সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের প্রতি এক উন্মুক্ত চিঠি লিখেছেন দুই বিশিষ্ট নাগরিক—সিনিয়র অ্যাডভোকেট ও মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্না এবং আইন বিভাগের অধ্যাপক এস এম মাসুম বিল্লাহ।

তারা চিঠিতে বলেছেন, বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা সংবিধানিক বিচারব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের ওপর সরাসরি আঘাত। তাঁরা বর্তমান প্রধান বিচারপতির কাছে বিষয়টি বিচারিক অথবা প্রশাসনিকভাবে আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে তাঁর নিজের ভেরিফায়েড একাউন্ট থেকে পোস্ট করা এস এম মাসুম বিল্লাহর চিঠি ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল –

মি. জাস্টিস সৈয়দ রেফাত আহমেদ
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি

ইওর এক্সিলেন্সি,
আমাদের সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা জানবেন।
আইনি সৌভ্রাতৃত্বের সদস্য ও দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা দু’জন আপনাকে এই উন্মুক্ত চিঠি লিখছি।
আপনি এই চিঠি স্ব:প্রণোদিত হয়ে বিচারিকভাবে অথবা প্রশাসনিকভাবে আমলে নিয়ে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। প্রতিষ্ঠিত বিচারিক সিদ্ধান্তে, এরকম চিঠি আমলে নেবার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। আপনার মাধ্যমে আমরা উচ্চ আদালতের অন্যান্য বিচারপতি মহোদয়গণেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মিস্টার জাস্টিস এবিএম খায়রুল হক আমাদের বিচারিক চিন্তার উন্মেষে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁর প্রদত্ত রায়সমূহ আমাদের সাংবিধানিক আইনবিজ্ঞানকে নানাভাবে ঋদ্ধ করেছে। তাঁর রায়ের সঙ্গে যে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে বা সমালোচনা করতে পারেন। সেই সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ আমাদের সাংবিধানিক পদযাত্রাকে সমৃদ্ধ করবে বলেই আমরা মনে করি।
কিন্তু সহ-বিচারকদের সহযোগে শুদ্ধ রায় দেবার কারণে বা এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অর্ধসত্য-অসত্য মিলিয়ে মামলা দিয়ে তাঁকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। মানবিক অভিজ্ঞান বলে যে, এটি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ন্যায়পরিচালন ব্যবস্থার জন্য একটি অশনি সংকেত হয়ে দেখা দেবে।
বিশেষ করে সাংবিধানিক মামলায় বিচারিক মতামতের বিরুদ্ধে এবং জুলাই আন্দোলনে ঢাকায় বা এর উপকণ্ঠে সংঘটিত কোন হত্যায় কাল্পনিকভাবে, মামলা দায়েরের একটি অসুস্থ ও অযাচিত ধারা অনুসরণ করে, তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা, অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য ফৌজদারী মামলা করা হয়েছে। তাঁকে গ্রেফতার করে যেভাবে হাতকড়া পরানো হয়েছে, আদালতে হাজির করা হয়েছে, রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে ইত্যাদি যেকোনো সংবিধানিক-ফৌজদারি-আইনবিজ্ঞানের মানদন্ডে অগ্রহণযোগ্য।
বিচারকদের সুরক্ষার সুপ্রতিষ্ঠিত যে সকল বিধিবদ্ধ বা কমন ‘ল নীতি রয়েছে, কোন (প্রধান) বিচারপতির গ্রেপ্তার তাঁর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই এই ঘটনা আমাদের বিচারিক সংস্কৃতিতে এক কলঙ্কের তিলক হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই ঘটনাটি আপনার বিবেককেও আচ্ছন্ন করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আপনার গৌরবজ্জ্বল পারিবারিক ঐতিহ্য, আপনার প্রজ্ঞা ও বিচারিক পাণ্ডিত্যের প্রতি আমাদের অনেক সমীহ রয়েছে। আপনি সমগ্র বাঙলাদেশের প্রধান বিচারপতি। আপনি জানবেন যে, বিচার শুধু করলেই চলে না, দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে এবং প্রাচুর্যপূর্ণভাবে প্রতিভাত হতে হয় যে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে।
রাষ্ট্রের দু’জন সচেতন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আপনার কাছে আমরা নিবেদন করছি যে, সাবেক প্রধান বিচারপতি জাস্টিস খায়রুল হকের বিরুদ্ধে আনীত এই মিথ্যা মামলা রহিত করার জন্য আপনি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অন্যতম অনুশীলনকারী হচ্ছে বিচার বিভাগ। সুতরাং নির্বাহী বিভাগের এই স্বেচ্ছাচারিতার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে আপনার প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার রয়েছে। সেটিই প্রকৃতপক্ষে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনুশীলনের অন্যতম মানদন্ড।
আপনি সেটি দ্রুত করে দেখাবেন এই বিশ্বাস আমরা করতে চাই।
এটি যদি না করা যায়, তাহলে আগামী দিনের রাজনৈতিক পরম্পরায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারকবৃন্দ কখনোই সুরক্ষিত থাকবেন না। এবং এক অর্থে ভাবলে দেখা যাবে যে, এরূপ ঘটনার প্রভাব আরো সুদূরপ্রসারী। আত্মঅবমানে, স্বয়ং বিচারকবৃন্দ, আস্থা সংকটে ভুগবেন, এবঙ নিজেদেরকে আর বিশ্বাস করতে পারবেন না। তাছাড়া, বাংলাদেশে আইনি পঠন-পাঠন, গবেষণা ও চিন্তায় এটি একটি স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করবে।
এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধের মহান লক্ষ্য সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, সুনাম, আইনের শাসন ও অন্যান্য মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
নিশ্চয়ই এ বিষয়ে আপনি সচেতন রয়েছেন। সার্বভৌম সংসদের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সভ্যবৃন্দের কাছে এ ব্যাপারে আমাদের আর কোন প্রত্যাশা অবশিষ্ট নেই।
আমরা আপনার মুখের দিকে চেয়ে আছি। আপনি নিদেনপক্ষে বিচারপতি খায়রুল হকের জামিনের পথের অদৃশ্য বাধাগুলোতে নজর দিন এবং তাঁর পক্ষে যোগ্য আইনি লড়াই হবার পথ উন্মুক্ত করুন। তাহলে আমরা আইনের শাসনকে প্রতিপালিত হতে দেখবো ।
আধুনিককালে আইন একটা প্রসেস। সেজন্য, আমরা গবেষণা ও একাডেমিক মানস থেকে দেখার জন্য আগ্রহী থাকবো যে, আপনার নেতৃত্বে বিচারবিভাগ সেই বিচারিক কার্যক্রম কিভাবে নিষ্পন্ন করেন।
আপনার সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনায় —
জেড আই খান পান্না,
মুক্তিযোদ্ধা, মানবাধিকার কর্মী ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট,
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
এবঙ
এস এম মাসুম বিল্লাহ (পিএইচডি, ওয়েলিঙটন)
অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (শিক্ষা ছুটিতে)
ভিজিটিং প্রফেসর, কোট দ্য জুর ইউনিভার্সিটি, নিস, ফ্রান্স।