আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য: তত্ত্ব ও ব্যবহারবিধি (পর্ব-২)
মতিউর রহমান; জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট

আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য (পর্ব-৪); সংগ্রহ, জব্দকরণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ধারণা

মতিউর রহমান : ডিজিটাল ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন অর্থ এমন কার্যক্রম যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস বা অন্য ডিজিটাল স্টোরেজ মিডিয়ায় সংরক্ষিত বা অবস্থিত ডেটা চিহ্নিতকরণ, অধিগ্রহণ ও বিশ্লেষণ করে ডিজিটাল সাক্ষ্য সংগ্রহ, স্থানান্তকরণ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনকে বোঝায়।ডিজিটাল বিষয়ের অতিরাষ্ট্রিক (Borderless) মাত্রা যুক্ত থাকায় আদালতে অপরাধের সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণযোগ্যভাবে উপস্থাপন করার নিমিত্ত আন্তর্জাতিক মান ও পদ্ধতি অনুসরণ আবশ্যক।

তাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধিমালা ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহের জন্য ডিজিটাল স্পেস বা ডিজিটাল ডিভাইসে অপরাধ তদন্তের নির্দেশনা দিতে। এই উদ্দেশ্যে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ ও সাইবার সিকিউরিটি এক্ট-২০২৩ -ধারা ১০ অনুসারে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি গাইড লাইন ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়।

আর পড়ুন : আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য: তত্ত্ব ও ব্যবহারবিধি (পর্ব-১)

তাছাড়াও, ডিজিটাল আলামত সংগ্রহ ও জব্দকরণ বিষয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সঠিকভাবে আলামত জব্দ করে উপস্থাপনবাফরেনসিক বিশ্লেষণের নিমিত্ত প্রেরণ হয়েছে কি না তা সাক্ষ্যের অখণ্ডতা ও সত্যতা নির্ধারণের জন্য জানা আবশ্যক।

তাই ডিজিটাল সাক্ষ্যের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে ও সঠিক ডিজিটাল ইনভেস্টিগেশন হয়েছে কি না তা নির্ণয়ে আলামতের সঠিক জব্দকরণ, উপস্থাপন ও পরীক্ষার নিমিত্ত প্রেরণ বিষয়ে তদন্তকারী, আদালত ও আইনজীবীদের জানা আবশ্যক।  তাই, ডিজিটাল সাক্ষ্য সংক্রান্ত পূর্ববর্তী পর্বের ধারাবাহিকতায় এই বিষয়ে প্রাথমিক ধারণাগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো;

মোবাইল ফো

মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে ফোন পাওয়া মাত্রই ফোনের সকল নেট কানেকশন, ব্লুটুথ, wi-fi অফ করে এয়ারপ্লেন বা ফ্লাইট মোড অন করতে হবে।যেকোন ধরণের পাসওয়ার্ড যেমনঃ প্যাটার্ন লক, পিন লক, ফোল্ডার লক, অ্যাপ লক,ফেসলক, পাসকোড আনলক বা ডিজেবল করতে হবে ও পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতে হবে।তাছাড়া, পরবর্তীতে পাসওয়ার্ড ছাড়া লক খোলার সময় ডেটা হারিয়ে যেতে পারে।

জব্দ তালিকায় সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোনের ব্র্যান্ড নেম, ফোনের মডেল, আই এম ই আই নাম্বার, সংযুক্ত সিম কার্ড ও মেমোরি কার্ড এর বর্ণনা, ম্যানুফ্যাকচার কোম্পানির নাম, ধারণক্ষমতা, সিরিয়াল নাম্বার, ইত্যাদি উল্লেখ করতে হবে।

আর পড়ুন : আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য: তত্ত্ব ও ব্যবহারবিধি (পর্ব-২)

মোবাইল ফোনের ক্লাউড স্টোরেজ, গুগল ড্রাইভ, ড্রপবক্স, আই ক্লাউড, ওয়ান ড্রাইভ, মি ক্লাউড, সামসাং ক্লাউডসসহ বিভিন্ন ক্লাউডের লগইন আইডি ও পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতে হবে এবং ইনফরমেশন বা ডকুমেন্ট অন্য কোন স্টোরেজ ডিভাইসেকপি করে জব্দ করতে হবে। ফোনের চার্জার সহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদিও জব্দ করা উচিত।

কম্পিউটা

কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপের ক্ষেত্রে উক্ত ডিভাইসের নাম, মডেল ও সিরিয়াল নাম্বার, জব্দ তালিকায় উল্লেখ করতে হবে। কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপের সংযুক্ত HDD, SD বা অন্য কোন স্টোরেজ ডিভাইসের ম্যানুফ্যাকচার কোম্পানির নাম, ধারণ ক্ষমতা, সিরিয়াল নাম্বার ইত্যাদি উল্লেখ করতে হবে। ঘটনাস্থলেচালু অবস্থায় প্রাপ্ত কম্পিউটারের পাওয়ার কটটি খুলে কম্পিউটার বন্ধ করতে হবে। কম্পিউটার কখনোই নরমাল শাটডাউন দিয়ে বন্ধ করা যাবে না।

আর পড়ুন : আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য : কিছু প্রযুক্তিগত বিষয়, যা জানা জরুরি (পর্ব-৩)

ঘটনাস্থলে প্রাপ্ত ডিজিটাল প্রমাণ যেভাবে থাকবে সেই অবস্থাতেই মার্কিং করে জব্দ করতে হবে।কম্পিউটার সিস্টেমে সংযুক্ত সকল ডিভাইস জব্দ করতে হবে। এইগুলো করার সময় ছবি তুলে বা ভিডিও করে রাখা উচিত। ফলে পরবর্তীতে বিভিন্ন উদ্ভূত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে এবং সিস্টেম পুনরায় একইভাবে সেট আপ করতে সহজ হবে।

সোশ্যাল মিডিয়া

ফেসবুক, Whatsapp, টেলিগ্রাম, ইউটিউব,ইমো,টিকটক, ভাইবার, ভিগো লাইভ, এক্স বা টুইটার, ইন্সটাগ্রাম এর ক্ষেত্রে লগইন আইডি, পাসওয়ার্ড উদ্ধার করতে হবে। পাসওয়ার্ড, রিকভারি আইডি ও পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করতে হবে যাতে করে অন্য কেউ একাউন্টে লগইন করে আলামত নষ্ট করতে না পারে। উক্ত আইডির টু ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন চালু করতে হবে। অনেক সময় অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের সহযোগী উক্ত একাউন্ট রিকভার করে অ্যাকাউন্ট ডিলিট বা আলামত নষ্ট করতে পারে।

এই জন্য Download your information অথবা ফেসবুক ইনফর্মেশন কপি ডাউনলোড করে সিডি কিংবা অন্য কোন স্টোরেজ ডিভাইসেকপি করে তা জব্দ করতে হবে। Whatsapp বা অন্যান্য চ্যাটিং অ্যাপস এর ক্ষেত্রে এপ লগ অ্যাক্টিভ থাকলে পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে তা রিমুভ করতে হবে।ম্যাসেজ  ডিজেবল টাইমার অন থাকলে বন্ধ করতে হবে।

প্রয়োজনে মামলা সংশ্লিষ্ট একাউন্টের চ্যাটexport করতে হবে। বিতর্কিত ছবি, ভিডিও, ভয়েস ম্যাসেজ  ও অ্যাটাচমেন্ট থাকলে তা ডাউনলোড করে অন্য কোন স্টোরেজ ডিভাইসেকপি করে সংগ্রহ করতে হবে এবং প্রয়োজনে স্ক্রিনশটসহ জব্দ করতে হবে।ডাউনলোড করা এটাচমেন্ট ফাইল Whatsapp এর সংশ্লিষ্ট ফোল্ডার হতে সরিয়ে অন্য ফোল্ডারে রাখা উচিত তাহলে প্রেরক তা  unsend করলেও হারিয়ে যাবে না।

জিমেইল, ইয়াহু মেইল, হট মেইল এর ক্ষেত্রে লগইন আইডি ও পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে প্রয়োজনে রিকভার পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে নিজ হেফাজতে নিতে হবে যেন আলামত নষ্ট করতে বা মুছে ফেলতে না পারে। ইমেইলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট একাউন্টের ইমেইল কনটেন্ট ডাউনলোড করে অন্য কোন স্টোরেজ  ডিভাইসে কপি করে বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রিন্ট করে তা জব্দ করতে হবে।

সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত আলামত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অ্যাক্সেস ইনফো, লগ ইন আইডি ও পাসওয়ার্ড লিখে রাখতে হবে। ইনফর্মেশনগুলো কপি বা ডাউনলোড করে সিডি,DVD-তে কপি করে রাখতে হবে। পোস্টগুলো আর্কাইভ করে রাখতে হবে এবং URL সহ স্ক্রীনশট নিতে হবে। চ্যাটিং অ্যাপস এর ক্ষেত্রে চ্যাট এক্সপোর্ট এর মাধ্যমে আলামত সংগ্রহ করে তা সিডি, ডিভিডি কিংবা অন্য কোন স্টোরেজ ডিভাইসে কপি করে রাখতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞের নিকট বিশ্লেষণে প্রেরণ করতে হবে, তাছাড়া যেকোন ভাবে কনটেন্ট ডিলিট বা নষ্ট হতে পারে।

স্ক্রিন

কোন পোস্টেরবা ওয়েবসাইটের স্ক্রিনশট গ্রহণ করার সময় কম্পিউটার বা স্মার্টফোন ব্যবহার করে URL সহ স্ক্রীনশট নিতে হবে এবং উক্ত স্ক্রীনশট প্রিন্ট করে বা স্টোরেজ মিডিয়ায় কপি করে জব্দ করতে হবে। Whatsapp এর চ্যাটের স্ক্রিনশট নেয়ার সময় এমনভাবে নিতে হবে যেন অপরপক্ষের ফোন নাম্বার দৃশ্যমান হয়। কারণ, ফোনবুকে নাম্বার যেকোন নাম দিয়ে save করা যায় যা Whatsapp এর আইডি হিসেবে দৃশ্যমান হয়।

তাই অন্য কারো নাম্বার টার্গেটেড ব্যক্তির নাম দিয়ে save করে ম্যাসেজিং করে তা স্ক্রিনশট নিয়ে জাল সাক্ষ্য সৃজন করা যেতে পারে বা এই ধরণের অভিযোগ উঠতে পারে। তাছাড়া, স্ক্রিন রেকর্ডিং করে যেকোনো স্টোরেজ মাধ্যমে কপি করে জব্দ করা যেতে পারে এবং সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে।

সিসিটিভি ফুটেজ

সিসিটিভি আলামত হিসেবে সংগ্রহের ক্ষেত্রে DVR বা NVR জব্দ করতে হবে, সিসিটিভি ক্যামেরা এর কেবল ও নেট কানেকশন খুলে ফেলতে হবে।DVR জব্দ করার সময় এর ভিতরের HDD বা SSD আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। প্যাটার্ন লক বা লগইন পাসওয়ার্ড থাকলে সংগ্রহ করতে হবে। DVR বা NVR ডিভাইসের সিস্টেম সেটিং এর Date, time ও প্রকৃত Time জব্দ তালিকায় উল্লেখ করতে হবে কারণ সময়ের অসামঞ্জস্যতা থাকতে পারে যা মামলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ওয়াইফাই সিসিটিভি ও স্মার্ট সিসিটিভি জব্দ করার সময় মেমোরি কার্ড সহ জব্দ করতে হবে।কোন যৌক্তিক কারণে সেগুলো জব্দ করা সম্ভব না হলে CD বা পেন্ড্রাইভে কপি করে জব্দ করতে হবে। এমনকি DVR,NVR জব্দ করা হলেও পেন্ড্রাইভে কপি করে রাখা উচিত।

য়েস রেকর্ড

বিতর্কিত ভয়েস সংগ্রহপূর্বক সিডি, ডিভিডি,পেনড্রাইভ কিংবা অন্য কোন স্টোরেজ ডিভাইসে কপি করে জব্দ করতে হবে। ফরেনসিক করার জন্য নমুনা ভয়েজ এর ক্ষেত্রে ভিকটিম বা সাক্ষীর সর্বনিম্ন ৩মিনিটের তিনটি নমুনা ভয়েস আদালতের সম্মুখে সংগ্রহ পূর্বক সিডি বা ডিভিডিতে কপি করে ডিজিটাল ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠাতে হবে অথবা আদালতের অনুমতি নিয়ে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবেগিয়ে নমুনা ভয়েজ প্রদান করতে হবে।

বি

ছবির সফট কপি ডিভাইস হতে স্টোরেজ মাধ্যমে কপি করে জব্দ করতে হবে। তাছাড়া, ছবি কাগজে প্রিন্ট করে হার্ড কপি জব্দ করে দাখিল করা যেতে পারে। এডিটেড কি না তা পরীক্ষার জন্য বা মেটাডেটা উদ্ধারের জন্য ছবির সফট কপি জব্দ করে প্রেরণ করতে হবে।ছবি আলোকচিত্র শাখায় পরীক্ষার জন্য ভিকটিম বা অভিযুক্তদের 3r বা 4r সাইজের ফ্রন্ট, লেফট ও রাইট সাইডের এক কপি করে নমুনা ছবি সংগ্রহ করে প্রেরণ করতে হবে।

নেটওয়ার্ক সার্ভা

নেটওয়ার্ক সার্ভার বা ডেটা  সেন্টার থেকে আলামত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সিস্টেম অ্যাডমিনের সাথে পরামর্শ করে টার্গেট পিসির স্টোরেজ মিডিয়ায় লাইভ একুইজিশন করতে হবে। তা পোর্টেবল হার্ডডিস্ক বা অন্য ডিভাইসে কপি করে জব্দ করতে হবে।

আলামত জব্দকরণ ও সংরক্ষণে চেইন অফ কাস্টডি

ডিজিটাল আলামত ইলেকট্রোস্ট্যাটিক ব্যাগ বা ফ্যারাডে ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে।জব্দ তালিকায় ও আলামতগুলোর প্যাকেটের উপর সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিতে হবে।জব্দকৃতআলমত হতে কোন ডেটা  আদান-প্রদান ও পরিবর্তন করা যাবে না। আলামত জব্দের পর কোন ছবি, ভিডিও ডকুমেন্ট ওপেন করা বা কোন তথ্যের স্ক্রীনশট নেয়া যাবে না। তদন্তকারী বা আসামি বা অন্য কোন ব্যক্তির দ্বারা কোনরূপ পরিবর্তন না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।ডিজিটাল আলামতের পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বর্ণনা উল্লেখ পূর্বক একটি নির্ভুল জব্দ তালিকা তৈরি করতে হবে। আলামতগুলোর চেইন অফ কাস্টডি ফরম পূরণ করতে হবে এবং চেইন অফ কাস্টডির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে।

সার্টিফিকেট সংগ্রহ

ডিজিটাল প্রমাণ বা আলামত সংগ্রহের সময়েই সাক্ষ্য আইনের ৬৫খ ধারার অধীনে সংশ্লিষ্ট ডিভাইস বা সিস্টেম এর মালিক বা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির নিকট হতে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে।

ডিজিটাল সাক্ষ্যের সত্যতা, নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিতে সঠিক ভাবে আলামত সংগ্রহ, জব্দকরণ ও সংরক্ষণ আবশ্যক। উল্লিখিত, বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন আমার লিখিত বইআদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য:তত্ত্ব ও ব্যবহারবিধি”।

লেখক : মতিউর রহমান; সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বাগেরহাট।