আল মুস্তাসীম নবী নিকু : বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ব্যবস্থায় নাবালকের স্বার্থ রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়। বিশেষ করে যখন নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তরের প্রশ্ন আসে, তখন এটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাধারণত পিতা নাবালকের প্রাকৃতিক অভিভাবক হিসেবে বিবেচিত হন। তবে পিতা মৃত্যুর পর মা পারিবারিক আদালতের আদেশে অভিভাবক নিয়ুক্ত হতে পারেন। অভিভাবক নিয়ুক্তির পর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে আদালতের অনুমতিক্রমে নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি সম্ভব।
কিন্তু আদালতের অনুমোদিত বিক্রয়ের আদেশ থাকলেও কখনো কখনো সাব-রেজিস্ট্রারগণ দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে থাকেন—এতে উদ্ভব হয় গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্ন। এই প্রবন্ধে নাবালকের অভিভাবক কর্তৃক সম্পত্তি বিক্রয়ের অনুমতি পাওয়ার পর রেজিস্ট্রারের বাধ্যবাধকতা এবং আদালতের আদেশের বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে নিবিড় আলোচনা করা হলো।
সংক্ষিপ্ত ঘটনার চিত্রায়ন
ধরা যাক, একজন নারী ‘কআক্তার’, স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র নাবালক পুত্র ‘খইসলাম’-এর অভিভাবক নিয়ুক্ত হন পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে। পরে সন্তানের কল্যাণার্থে এবং শিক্ষা খরচ মেটাতে তিনি আদালতের কাছে আবেদন করেন তফশীলভুক্ত একটি সম্পত্তি বিক্রির অনুমতির জন্য। আদালত আবেদনটি বিবেচনা করে বিধিসম্মত প্রক্রিয়ায় নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবক হিসেবে তাকেঅনুমতি দেন উক্ত সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য।
পরে কআক্তার দলিল প্রস্তুত করতে নিবন্ধনের জন্য রেজিস্টার/সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে উপস্থিত হন, কিন্তু তারা আদালতের আদেশে সরাসরি তফশীল না থাকায় রেজিস্ট্রেশন করতে অস্বীকৃতি জানান। অথচ মোকদ্দমার আরজি ও বিক্রয়ের অনুমতি দরখাস্ত উভয়েই তফশীল সংযুক্ত ছিল।
মূল আইনগত প্রশ্ন
আদালতের অনুমতি থাকলেও শুধুমাত্র আদেশে তফশীলের বর্ণনা না থাকায়—এই কারণে কি সাব-রেজিস্ট্রার দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন?
আইনগত বিশ্লেষণ
গার্ডিয়ান ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০
ধারা ৭ অনুসারে আদালত যখন নাবালকের অভিভাবক নিয়োগ করেন, তখন সেই অভিভাবক নাবালকের কল্যাণের স্বার্থে তার সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বা ক্রয়ের ক্ষমতা আদালতের অনুমতির ভিত্তিতে প্রয়োগ করতে পারেন। এখানে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো “welfare of the minor”।
দেওয়ানি কার্যবিধি (Code of Civil Procedure), ১৯০৮
ধারা ১৫১, ১৫২ ও ১৫৩ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাসঙ্গিক।
-
ধারা ১৫১: আদালতের ন্যায্যতা ও সুবিচারের স্বার্থে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেয়।
-
ধারা ১৫২: আদেশবাড়ির অঙ্ক সংক্রান্ত বা টাইপ সংক্রান্ত ভুল সংশোধনের ক্ষমতা দেয়।
-
ধারা ১৫৩: আদালতের ক্ষমতা প্রদান করে যে, কোনো কার্য বিবরণী সংশোধন বা তথ্য সংযোজন করতে পারে যা ভুল বা অস্পষ্টতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয়।
তবে প্রশ্ন ওঠে, আদালতের পূর্বের আদেশে তফশীল উল্লেখ না থাকায় রেজিস্ট্রার দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন কিনা? এখানে মূল বিষয় আদালতের আদেশের পরিপূরক নথির প্রতি দৃষ্টিপাত।
আদালতের আদেশের সঙ্গে মোকদ্দমার আরজি ও বিক্রয়ের অনুমতির দরখাস্তে তফশীল যুক্ত থাকলে এবং আদালত তার ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশন চাওয়া হলে রেজিস্ট্রারের দলিল গ্রহণ না করার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮
ধারা ৩২ অনুসারে দলিল রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় দলিলদাতার উপস্থিতি, সঠিকতা যাচাই এবং দলিল আইনীভাবে গ্রহণযোগ্য কিনা যাচাই করার দায়িত্ব রেজিস্ট্রারের।
ধারা ৩৪ অনুযায়ী রেজিস্ট্রার কেবলমাত্র দলিল উপস্থাপনের নিয়ম ও দলিলের প্রকৃত খতিয়ে দেখে। আদালতের আদেশ যদি যথাযথভাবে দেওয়া হয় এবং প্রয়োজনীয় দলিল যেমন তফশীলসহ দরখাস্ত ও অনুমতির জাবেদাকপিদলিলের সঙ্গে যুক্ত থাকে—তাহলে রেজিস্ট্রারের কাজ দলিল রেজিস্ট্রেশন করা, তা অস্বীকার করা নয়।
রেজিস্ট্রেশনের বাধ্যবাধকতা
আদালতের আদেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সম্পত্তি বিক্রির অনুমতি থাকলে রেজিস্ট্রার কেবলমাত্র অনুমতির আদেশে সরাসরি তফশীল থাকার বিষয়ে নজর দিবেন না। বরং তিনি নিশ্চিত করবেন—
-
আদেশ প্রকৃত ও বৈধ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কিনা,
-
আদেশের সঙ্গে মোকদ্দমার আরজি ও বিক্রয়ের অনুমতি দরখাস্তে তফশীল যুক্ত আছে কিনা,
-
দলিল আইনি নিয়ম অনুসারে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য কিনা।
এই বিষয়গুলো সঠিক থাকলে রেজিস্ট্রার দলিল রেজিস্ট্রেশন না করলে সেটি “excess of jurisdiction” বা ক্ষমতার অপব্যবহার হবে।
আদালতের নির্দেশ ও রেজিস্ট্রারের প্রতিবাধ্যবাধকতা
সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুসারে নিম্ন আদালত উচ্চ আদালতের নির্দেশ মানতে বাধ্য। আদালতের কার্যকর আদেশ অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি রেজিস্ট্রেশন অফিসে যান এবং আদেশ কার্যকর করতে চান, রেজিস্ট্রারকে আদেশ মেনে নিতে হবে। রেজিস্ট্রার আদেশ মানতে ব্যর্থ হলে আদালত প্রয়োজনমতো তাকে তলব বা নোটিশ জারি করতে পারেন।
আদালতের আদেশে পুনরায় তফশীল সংযোজনের প্রয়োজন নেই
দেওয়ানিকার্যবিধির ধারা ১৫৩ অনুযায়ী, আদালতের কোনো আদেশে প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র বা তথ্য থাকলে একাধিকবার একই আদেশে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না। আদালতের আদেশ, দরখাস্ত এবং তফশীল একত্রে উপস্থাপন করলে তা সম্মিলিতভাবে কার্যকর দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
পরিশেষে
নাবালকের অভিভাবক কর্তৃক সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য আদালতের অনুমতি একটি চূড়ান্ত ও কার্যকর আদেশ। আদেশে সরাসরি তফশীল না থাকলেও যদি মূল দরখাস্ত ও প্রার্থনায় সম্পূর্ণ বিবরণ থাকে এবং আদালত তা অবগত হয়ে আদেশ দেন, তবে সেই আদেশ কার্যকর। রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের কোনো ধারা রেজিস্ট্রারকে এমন পরিস্থিতিতে রেজিস্ট্রেশন প্রত্যাখ্যানের অনুমতি দেয় না। বরং এরূপ অস্বীকৃতি প্রশাসনিক সীমা অতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত। আদালতের আদেশ মানা রেজিস্ট্রারের বাধ্যবাধকতা এবং এ ধরনের বিলম্ব নাবালকের স্বার্থের পরিপন্থী।
লেখক : অ্যাডভোকেট, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট।