মো. ফয়জুল হক : বর্তমানে অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সিভিল ফোর্সের সদস্য বা মিলিটারি বা প্যারা-মিলিটারি পার্সন অর্থাৎ মিলিটারি বা প্যারা মিলিটারি সদস্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাবলে হোক কিংবা না হোক; কোনো স্থানে, যেখানে অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে বা হবার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন বা নিরাপরাধ ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেফতার করে তাৎক্ষণিক প্রহার করেন। এই বিষয়ে সিভিল এবং মিলিটারি আইন কি বলেন?
অপরাধের সংজ্ঞা
প্রথমে আমরা জানি অপরাধ কী বা কাকে বলে? বিভিন্ন অপরাধবিজ্ঞানীরা অপরাধের বিভিন্ন সজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন, একজন আইনজীবী ও সমাজবীদ Paul W. Tappan অপরাধের সজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে,
Crime is an intentional act or omission in violation of criminal law, committed without defence or justification, and sanctioned by the laws as felony or misdemeanor.
আবার বিখ্যাত আইন বিজ্ঞানী John Austin এর মতে,
A wrong which is pursued at the discretion of the injured party and his representatives is a civil injury; a wrong which is pursued by the sovereign or his subordinates is a crime.
তবে বাংলাদেশের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪০ ধারায় বলা হয়েছে যে, এই কোডের অধীন শাস্তিযোগ্য যেকোনো কাজই হচ্ছে অপরাধ। ইহা ছাড়াও যেইসকল বিশেষ আইনে যেই কার্যকে অপরাধ হিসেবে সজ্ঞাহিত করা হয়েছে তাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আর যেই কার্য কোনো সাধারণ বা বিশেষ আইনে অপরাধ হিসেবে সজ্ঞাহিত করা হয় নাই তা ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। অর্থাৎ কোন কাজটি অপরাধ হবে তা আইন দ্বারা অবশ্যই নির্ধারিত হতে হবে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও গ্রেফতারের ক্ষমতা
বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্টের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেক নাগরীক বা দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত বিদেশি নাগরিকদেরকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রাষ্ট সেই দায়িত্ব পালন করেন তার নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যদের দ্বারা। আবার নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের সম্মুখে সংঘঠিত বা সংঘঠনের সম্ভাবনা রয়েছে এমন অপরাধকে প্রতিহত করা।
বাংলাদেশে অপরাধ সম্পর্কিত প্রায়োগিক আইন অর্থাৎ ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধি মতে অপরাধের সহিত সম্পর্কিত বা সন্দেহবাজন ব্যক্তিকে যে কেউ গ্রেফতার করতে পারেন। গ্রেফতারকারী ব্যক্তি হতে পারেন সিভিল পার্সন যেমন- আমি বা আপনি, সিভিল ফোর্সের পার্সন যেমন- পুলিশ, র্যাব ইত্যাদি, ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারক বা বিচারপতি এবং মিলিটারি (আর্মি, নৌ ও বিমান বাহিনী) বা প্যারা-মিলিটারি (বিজিবি) পার্সন।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে কীভাবে গ্রেফতার করতে হবে। উক্ত আইনে বলা হয়েছে যে, আপনি শুধুমাত্র আপনার মুখের শব্দ দিয়ে বা অভিযুক্ত ব্যক্তির শরীর স্পর্শ করে বা অভিযুক্ত ব্যক্তির শরীর আটক করে অথবা প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করতে পারেন। তবে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগেরও সীমা রয়েছে যাকে আমরা বলি ‘প্রয়োজনীয় শক্তির ব্যবহার’ বা ‘Reasonable Use of Force’।গ্রেফতারের সময় প্রয়োজনীয় শক্তির অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহার করা হলে এর দ্বায়ভার অবশ্যই গ্রেফতারকারী ব্যক্তিকে বহন করতে হবে।
গ্রেফতারের পদ্ধতি
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ ধারাকে ব্যাখ্যা করলে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিন্মোক্ত পদ্ধতিতে গ্রেফতার করা যায়-
(ক) মুখের শব্দের মাধ্যমেঃ আপনাকে গ্রেফতার করা হলো বা You are under arrest বা‘STOP’।
(খ) শরীর স্পর্শ করার মাধ্যমেঃ শুধু মাত্র অভিযুক্ত ব্যক্তির কাঁধে বা কোমড়ের বেল্টে বা হাত ধরা মাত্রই অভিযুক্ত গ্রেফতার।
(গ) শরীর আটক করার মাধ্যমেঃ অভিযুক্তকে একা বা সঙ্গীয় ফোর্স বা একাধিক সদস্য দ্বারা পাকরাও করে বা একটি নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে আটক করে রাখারা মাধ্যমে গ্রেফতার করা যাবে।
(ঘ) প্রয়োজনীয় শক্তির ব্যবহারঃ এখন একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি গ্রেফতারকারীর প্রতি আক্রমণ করেন বা করার আশংকা করেন বা পলায়নের চেষ্টা করেন তাহলে গ্রেফতারকারী ব্যক্তি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটকের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির ব্যবহার করে গ্রেফতার করা যাবে। প্রয়োজনীয় শক্তির ব্যবহার হচ্ছে সেইটুকু শক্তি যেই শক্তি ব্যবহার না করলে অভুযুক্তকে গ্রেফতার করা সম্ভব না।
প্রয়োজনীয় শক্তির সীমা
প্রয়োজনীয় শক্তির ব্যবহারের সীমা কতটুকু হবে তা নির্ভর করে অভিযুক্তের আক্রমণ বা পলায়নের অবস্থার উপর। অভিযুক্তকে যদি সামান্য আঘাতের মাধ্যমে গ্রেফতার করা যায় তাহলে সামান্য শক্তি ব্যবহার করা যাবে। আবার অভিযুক্তকে গ্রেফতারের জন্য যদি গুরুতর আঘাতের প্রয়োজন হয় তাহলে গুরুতর আঘাত করা যাবে। আবার অভিযুক্ত যদি গ্রেফতারকারী ব্যক্তির প্রতি হত্যার উদ্দেশ্যে পালটা আঘাত করে তাহলে গ্রেফতারকারী ব্যক্তি আত্মরক্ষার্থে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হত্যাও করতে পারবে।
তবে প্রয়োজনীয় শক্তির ব্যবহার যে যথোপযুক্ত ছিলো তা ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১০৫ ধারা মতে গ্রেফতারকারী ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে। আর আমরা জানি প্রমাণের সময় আসে অভিযোগ গঠনের পর। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় শক্তির ব্যবহার যদি অযথোপযুক্ত ছিলো মর্মে গ্রেফতারকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই অভিযোগ গঠন করা হবে। তবে তা বিজ্ঞ আদালতের বিবেচনাধীন ক্ষমতা।
অভিযুক্ত মানেই অপরাধী নয়
একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি মানে সে অপরাধী না। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আমরা অপরাধী বলতে পারি না। আর ফৌজাদারি অভিযোগ প্রমাণের নির্ধারীত সীমা হচ্ছে ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত’, অর্থাৎ Proof Beyond Reasonable Doubt. কীভাবে একটি ফৌজদারি অভিযোগকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে তার কলাকৌশল বিভিন্ন প্রায়োগিক আইনে বিস্তর ব্যাখ্যা করা আছে। কিন্তু আমরা যে দেখি বিভিন্ন সিভিল ফোর্সের সদস্য বা মিলিটারি বা প্যারা-মিলিটারি পার্সন অর্থাৎ মিলিটারি বা প্যারা-মিলিটারি সদস্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাবলে হোক কিংবা না হোক একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেফতার করে তাৎক্ষনিক প্রয়োজনীয় শক্তির চেয়ে বেশি শক্তি অভিযুক্তের উপর ব্যবহার করেন। অর্থাৎ অভিযুক্তের শরীর আটক করে তাকে প্রহার করে থাকেন।
যেমন অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় বাইকে মাত্রাতিরিক্ত সাইলেন্সার ব্যবহার করার অভিযোগে অভিযুক্তের কানের মধ্যে উচ্চ শব্দের সাইলেন্সার লাগিয়েও প্রহার করে থাকেন। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, অভিযুক্তকে কান ধরে জনসম্মুখে উঠ-বস করানো হয়।তাহলে গ্রেফতারকারীর এইরূপ কার্যকে আমরা কী বলব? কেননা গ্রেফতারকারী কর্মকর্তার এইরূপ কার্য অভিযুক্তের শারীরিক ব্যাথার কারণ হয়ে থাকে। আবার গ্রেফতারকারী কর্মকর্তা এইরূপ কার্য করার জন্য কি ক্ষমতাপ্রাপ্ত?
আইন ও বাহিনীর সদস্য
আইন মানুষের কার্যকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে। আমি চিন্তা করতে পারি যে জনাব ‘ক’ কে আমি খুন করবো। কিন্তু আইন আমাকে জনাব ‘ক’ কে খুন করার অনুমতি দেন না। এখানে আইন আমার চিন্তার বহিঃপ্রকাশকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। আবার যদি সেই ব্যক্তি হন কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য! তাহলে সেই সদস্যের আইন প্রয়োগে প্রত্যেকটি কাজ হবে আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত। প্রত্যেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নির্ধারিত আইন প্রণয়ন করে দিয়েছেন যা পালনীয় সেই সকল সদস্যদের জন্য বাধ্যকর।
কিন্তু সেই সদস্য যদি হয় মিলিটারি বা প্যারা-মিলিয়াটারি সদস্য! মিলিটারি সদস্য অর্থাৎ আর্মি বাহিনীর জন্য ১৯৫২ সালের দ্যা আর্মি এক্ট, নৌবাহিনীর জন্য ১৯৬১ সালের দ্যার নেভি অর্ডিন্যান্স, বিমানবাহিনীর জন্য ১৯৫৩ সালের দ্যা এয়ার ফোর্স এক্ট এবং প্যারা-মিলিটারি বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের জন্য ২০১০ সালের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন রাষ্ট্র প্রণয়ন করে দিয়েছেন যা এইসকল বাহিনীর সদস্যদের জন্য অবশ্য পালনীয় বিধান।
এই সংশ্লিষ্ট আইনের বিধান বহিঃর্ভুত যেকোনো কার্য যা সেই আইনে অপরাধ হিসেবে সজ্ঞাহিত করা হয়েছে তা সেই সংশ্লিষ্ট সদস্যের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তবে এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা উচিৎ যে এই সকল মিলিটারি বা প্যারা মিলিটারি আইন সংশ্লিষ্ট বাহিনীর ভিতরে প্রযোজ্য। কিন্তু যখন একজন মিলিটারি বা প্যরা-মিলিটারি সদস্য একজন সিভিলিয়ানকে আটক বা গ্রেফতারপূর্বক শারীরিকভাবে প্রহার করেন সেই বিষয়ে মিলিটারি বা প্যারামিলিটারি আইন কী বলে?
সিভিল অপরাধ ও বাহিনীর সদস্য
সিভিল অপরাধ বিষয়ে ১৯৫২ সালের দ্যা আর্মি এক্ট এর ৮(১১) ধারায় বলা হয়েছে যে, “offence” means any act or omission punishable under this Act and includes a civil offence as hereinbefore defined; আবার উক্ত আইনের ৮(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, “civil offence” means an offence which, if committed in Bangladesh, would be triable by a criminal court। অর্থাৎ মিলিটারি সদস্য দ্বারা যদি এমন কোনো কার্য সম্পাদন করা হয় যা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ তা উক্ত সদস্যের দ্বারা সংগঠিত সিভিল অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩১৯ এবং ৩২০ ধারায় বলা হয়েছে Whoever causes bodily pain, disease or infirmity to any person is said to cause hurt and The following kinds of hurt only are designated as “grievous”
Firstly:- Emasculation;
Secondly:- Permanent privation of the sight of either eye;
Thirdly:- Permanent privation of the hearing of either ear;
Fourthly:- Privation of any member or joint;
Fifthly:- Destruction or permanent impairing of the powers of any member or joint;
Sixthly:- Permanent disfiguration of the head or face;
Seventhly:- Fracture or dislocation of a bone or tooth and
Eighthly: -Any hurt which endangers life or which causes the sufferer to be during the space of twenty days in severe bodily pain, or unable to follow his ordinary pursuits.
দণ্ডবিধির ৩১৯ ও ৩২০ ধারায় সজ্ঞাহিত কোনো কার্য কোনো মিলিটারি সদস্য দ্বারা সম্পাদিত হলে তা হবে উক্ত আইনের ৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৩৪ ধারা মতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ (ক্ষেত্রমতে)। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা মিলিটারি বা প্যারা-মিলিটারি বাহিনীর সদস্য দ্বারা আটক বা গ্রেফতার পূর্বক তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তকে যেই শারীরিকভাবে প্রহার করে থাকে তা উক্ত গ্রেফতারকারী সদস্য দ্বারা সংগঠিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে যা শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে।
বিচারিক এখতিয়ার
একজন মিলিটারি সদস্যের বিরুদ্ধে কী ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইন প্রয়োগযোগ্য? উক্ত আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, Nothing in this Act is intended to repeal, vary, suspend, or affect any of the provisions of any Act for punishing mutiny and desertion of officers, soldiers, sailors or airmen in the service of the Republic, or of any special or local law. এখানে শুধুমাত্র বাহিনীর সদস্য দ্বারা mutiny and desertion অপরাধের বিষয়ে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বাহিনীর বিশেষ আইনের বিধানকে ক্ষুণ্ণ করবে না মর্মে বিধান করা হয়েছে। কিন্তু বাহিনীর সদস্য দ্বারা সিভিলিয়ানের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিষয়ে বলা হয় নাই।
আবার ১৩৯ ধারায় বলা হয়েছে যে উক্ত আইনের ৭ নং অধ্যায় বর্ণিত অপরাধ বিষয়ে বাহিনীর সদস্যদের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি দ্বারা বিচার করা যাবে না। এখানেও সিভিলিয়ানের বিরুদ্ধে বাহিনীর সদস্য দ্বারা সংগঠিত অপরাধ বিষয়ে বলা হয় নাই। তবে সিভিলিয়ানদের বিরুদ্ধে বাহিনীর সদস্য দ্বারা সংগঠিত অপরাধের বিষয়ে ১৯৫২ সালের দ্যা আর্মি এক্ট কি বলে?
১৯৫২ সালের দ্যা আর্মি এক্টের ৫৯ ধারার বক্তব্য হচ্ছে উক্ত আইনের ২(৮) এবং ২(১১) ধারায় সজ্ঞায়িত অপরাধ সিভিল অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে যা ৫৯ ধারা মতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ কোনো মিলিটারি সদস্য দ্বারা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধ সংগঠন করলে তা ১৯৫২ সালের দ্যা আর্মি এক্টের ৫৯ ধারা মতে সিভিল অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে তবে সেই অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে ১৮৬০ সালের আইনে অভিযোগ গঠন না করে ১৯৫২ সালের আইনের ৫৯ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হবে। এর মর্মার্থ হচ্ছে, অপরাধ সংগঠিত হতে হবে অবশ্যই ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইন বা ভিন্ন কোনো সিভিল আইনের অধীন কিন্তু অভিযোগ গঠন হবে ১৯৫২ সালের দ্যা আর্মি এক্টের ৫৯ ধারায়।
দ্যা আর্মি এক্ট
বাহিনীর সদস্য যদি সিভিল অপরাধ করে থাকেন তাহলে তার বিচার কোন আদালতে হবে? আমরা জানি বাহিনীর সদস্যের বিচার হয়ে থাকে কোর্ট মার্শাল আদালতে যদি তা সংশ্লিষ্ট বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোনো অপরাধ হয়ে থাকে। ১৯৫২ সালের দ্যা আর্মি এক্টের ৮(৭) ধারায় ফৌজদারি আদালতের সজ্ঞা এইভাবে দিয়েছেন যে, “criminal court” means a court of ordinary criminal justice in Bangladesh, or established elsewhere by the authority of the Government।
কোনো সদস্য যদি সিভিল অপরাধ সংগঠিত করে থাকেন যা সিভিল ফৌজদারি আদালতে বিচারযোগ্য তাহলে ১৯৫২ সালের দ্যা আর্মি এক্টের ৯৫ ধারা মতে উক্ত সিভিল ফৌজদারি আদালত ভিক্টিমের নালিশ গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর জন্য সরকার দ্বারা নির্ধারিত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে নোটিশ দিবেন যেনো সিভিল অপরাধে অভিযুক্ত উক্ত বাহিনীর সদস্যকে নিকস্থ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করেন।
অথবা সংশ্লিষ্ট সিভিল ফৌজদারি আদালত সরকারের রেফারেন্সের জন্য নিবেদন পাঠিয়ে সরকার থেকে উত্তর না আসা পর্যন্ত কার্যক্রম স্থগিত রাখবেন। কিন্তু, বাহিনীর সদস্য যদি এমন একটি সিভিল অপরাধ সংগঠন করেন যা উভয় সিভিল ফৌজদারি আদালত এবং কোর্ট মার্শাল আদাল দ্বারা বিচারযোগ্য!
এই ক্ষেত্রে ১৯৫২ সালের দ্যা আর্মি এক্টের ৯৪ ধারা মতে সরকার দ্বারা নির্ধারিত কর্মকর্তা নির্ধারণ করবেন যে উক্ত সিভিল অপরাধের জন্য বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যের বিচার কোন আদালতে হবে। তবে সিভিল ফৌজদারি আদালত হোক কিংবা কোর্ট মার্শাল আদালত হোক, একজন অভিযুক্ত সদস্যের বিচার যেকোনো একটি আদালত দ্বারা সম্পাদিত হলে একই অপরাধের জন্য তাকে দুবারা কোনো আদালতে বিচার করা যাবে না।
দ্যা নেভি অর্ডিন্যান্স
যদি নৌ-বাহিনীর কোনো সদস্য দ্বারা সিভিল অপরাধ সংগঠিত হয় তাহলে ১৯৬১ সালের দ্যা নেভি অর্ডিন্যান্সের ৭৮ ধারা মতে অভিযোগ গঠন করা হবে এবং অভিযুক্ত সদস্যকে নেভি ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচার করা হবে। বাংলাদেশ নেভি বাহিনীর কোনো সদস্য সিভিল অপরাধ সংগঠন করলে যা উভয় নেভি ট্রাইব্যুনাল এবং সিভিল ফৌজদারি আদালত কর্তৃক বিচারযোগ্য হলে তা উক্ত আইনের ১০৭ ধারা মতে নির্ধারন করবেন বাংলাদেশ নেভি অথরিটি যে অভিযুক্ত সদস্যের বিচার কোন আদালতে হবে।তবে সিভিল ফৌজদারি আদালত হোক কিংবা নেভি ট্রাইব্যুনাল হোক, একজন অভিযুক্ত সদস্যের বিচার যেকোনো একটি আদালত দ্বারা সম্পাদিত হলে একই অপরাধের জন্য তাকে দুবারা কোনো আদালতে বিচার করা যাবে না।
দ্যা এয়ার ফোর্স এক্ট
আবার যদি বিমান বাহিনীর কোনো সদস্য দ্বারা সিভিল অপরাধ সংগঠিত হয় তাহলে ১৯৫৩ সালের দ্যা এয়ার ফোর্স এক্টের ৭১ ধারা মতে অভিযোগ গঠন করা হবে এবং ১২৪ ধারা মতে অভিযুক্ত সিভিল ফৌজদারি আদালত কর্তৃক বিচার করা হবে। এই ক্ষেত্রে ভিক্টিমের নালিশ গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর জন্য সরকার দ্বারা নির্ধারিত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে নোটিশ দিবেন যেনো সিভিল অপরাধে অভিযুক্ত উক্ত বাহিনীর সদস্যকে নিকস্থ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করেন।
অথবা সংশ্লিষ্ট সিভিল ফৌজদারি আদালত সরকারের রেফারেন্সের জন্য নিবেদন পাঠিয়ে সরকার থেকে উত্তর না আসা পর্যন্ত কার্যক্রম স্থগিত রাখবেন। কিন্তু, বাহিনীর সদস্য যদি এমন একটি সিভিল অপরাধ সংগঠন করেন যা উভয় সিভিল ফৌজদারি আদালত এবং কোর্ট মার্শাল আদাল দ্বারা বিচারযোগ্য! এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী নির্ধারণ করবেন যে উক্ত সিভিল অপরাধের জন্য বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যের বিচার কোন আদালতে হবে। তবে সিভিল ফৌজদারি আদালত হোক কিংবা কোর্ট মার্শাল আদালত হোক, একজন অভিযুক্ত সদস্যের বিচার যেকোনো একটি আদালত দ্বারা সম্পাদিত হলে একই অপরাধের জন্য তাকে দুবারা কোনো আদালতে বিচার করা যাবে না।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন
বিজিবি সদস্য দ্বারা যদি সিভিল অপরাধ সংগঠিত হয় তাহলে ২০১০ সালের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইনের ৫৩ ধারা মতে অভিযোগ গঠন করা হবে এবং অভিযুক্ত সদস্যকে ৮০ ধারা অনুযায়ী সিভিল ফৌজদারি আদালত কর্তৃক বিচার করা হবে। এই ক্ষেত্রে ভিক্টিমের নালিশ গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর মহাপরিচালক অথবা বিধি দ্বারা নির্ধারিত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে নোটিশ দিবেন যেনো সিভিল অপরাধে অভিযুক্ত উক্ত বাহিনীর সদস্যকে নিকস্থ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করেন।
অথবা সংশ্লিষ্ট সিভিল ফৌজদারি আদালত সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য নিবেদন পাঠিয়ে সরকার থেকে উত্তর না আসা পর্যন্ত কার্যক্রম স্থগিত রাখবেন। কিন্তু, বাহিনীর সদস্য যদি এমন একটি সিভিল অপরাধ সংগঠন করেন যা উভয় সিভিল সিভিল ফৌজদারি আদালত এবং বর্ডার গার্ড আদালত দ্বারা বিচারযোগ্য!
এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের মহাপরিচালক অথবা রিজিয়ন কমান্ডার অথবা সেক্টর কমান্ডার অথবা বিধিদ্বারা নির্ধারিত কর্মকর্তা নির্ধারণ করবেন যে উক্ত সিভিল অপরাধের জন্য বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যের বিচার কোন আদালতে হবে। তবে সিভিল ফৌজদারি আদালত হোক কিংবা বর্ডার গার্ড আদালত হোক, একজন অভিযুক্ত সদস্যের বিচার যেকোনো একটি আদালত দ্বারা সম্পাদিত হলে একই অপরাধের জন্য তাকে দুবারা কোনো আদালতে বিচার করা যাবে না।
ভিক্টিমের করণীয়
একজন সিভিলিয়ান অর্থাৎ অসামরিক সদস্য হিসেবে আমার কী করণীয়? আমি যদি কোনো মিলিটারি বা প্যারা-মিলিটারি বাহিনীর সদস্য দ্বারা নির্যাতিত হই তাহলে আমার করণীয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে নালিশী দরখাস্ত দায়ের করা। আমি যদি নালিশী দরখাস্তে অভিযুক্ত সদস্যের পুর্ণাঙ্গ নাম ও ঠিকানা দিতে পারি তাহলে আদালত উক্ত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিয়ে উক্ত বাহিনীর নির্ধারিত কর্মকর্তাকে অনুরোধ জানাতে পারেন যেনো অভিযুক্ত সদস্যকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করেন অথবা আমলে না নিয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্তের জন্য সরকারের নিকট নিবেদন জানিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত রাখতে পারেন।
আমি যদি অভিযুক্ত সদস্যের নাম ও ঠিকানা স্পষ্টত উল্লেখ না করতে পারি অথবা যেখানে অপরাধ ও অভিযুক্তকে সনাক্তের বিষয় থাকে যা তদন্ত স্বাপেক্ষে নির্ধারণ করা সম্ভব সেইক্ষেত্রে আদালত সংশ্লিষ্ট বেসামরিক আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন অথবা সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে লিখিত নিবেদন জানাতে পারেন যেনো সংগঠিত অপরাধ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন অথবা সরকারের নিকট যথোপযুক্ত সিদ্ধান্তের জন্য আবেদন জানাতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট বাহিনী উক্ত নিবেদন পাওয়ার পর আমলী আদালতকে অবহিত করবেন যে উক্ত বাহিনী নিজেই বিচার করবেন নাকি আমলী আদালতের এখতিয়ারে রাখবেন। যদি আমলী আদালতের এখতিয়ারে রাখেন তখন আমলী আদালত বাহিনীকে তদন্তের অনুরোধ জানাতে পারেন।যদি বাহিনী অনুরোধ গ্রহণ করেন তাহলে বাহিনীর তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন আমলী আদালতে প্রেরণ করবেন। তবে অনুরোধ রাখা না রাখার এখতিয়ার বাহিনীর উপর নির্ভর করে।
উপসংহার
অবশেষে বলতে চাই, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সে যেই হোক না কেন। আইন আজ অমান্যকারীকে প্রশ্রয় দিলে কাল তার দ্বারা প্রশ্রয়কারীও শিকার হতে পারে। একজন নাগরিক হিসেবে সর্বদা আইনকে শ্রদ্ধা করা উচিৎ। আইনের এখতিয়ার বহিঃর্ভুত এমন কোনো কাজ করা উচিৎ নয় যার জন্য ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেই আইনের ব্যপ্তয় ঘটাবে তাকেই আইনের আওতায় আনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
রাষ্ট্র এমন একটি জুডিশিয়াল সিস্টেম তৈরি করে রেখছেন যে সকলকেই সেই সিস্টেমের আইনের আওতায় আসতে হবে। হোক সে সিভিল পার্সন অথবা মিলিটারি পার্সন। মিলিটারি পার্সনরা আমাদের গর্ব ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী এবং আমাদের রাষ্ট্রের রক্ষাকবজ। কাজেই মিলিটারি পার্সল সর্বাপেক্ষায় সিভিলিয়ানদের প্রতি মায়াশীল হবেন তাই কাম্য। তাদের দ্বারা কোনো সিভিলিয়ান নির্যাতিত হবে তা রাষ্ট্র মোটেও আশা করেন না।
যদি কোনো সিভিলিয়ান অপরাধের সহিত জড়িত থাকেন তাহলে রাষ্ট্রের সূর্য সন্তান হিসেবে মিলিটারি সদস্যের কাজ হচ্ছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনের সিভিলিয়ান আইনশৃঙ্খলা ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া। অভিযুক্ত সিভিলিয়ানকে প্রহার করা না। তবে এই প্রেক্ষাপট খুবই নগণ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মিলিটারি সদস্যরা সিভিলিয়ানদের অসামাজিক আচরণের পরেও অধিক ধৈর্য্য ধারণ করে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনেন। কিন্তু হাতেগোনা কিছুমাত্র প্রেক্ষাপটের কারণে আমাদের গর্বের বাহিনীর উপর যেনো আঁচ না আসে সেই দিকে সামরিক বাহিনীকে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। ই-মেইল: smfayzul@gmail.com