সংবিধান বাতিল হলে দেশের অভ্যন্তরীণ শাসন ও সার্বভৌমত্বের ওপর গভীর প্রভাব পড়ে; তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও আইনি কাঠামো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
রাজনৈতিক বিজ্ঞানে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলতে বোঝায় এমন একটি রাজনৈতিক সত্তাকে, যা তার নিজস্ব ভূখণ্ড ও জনগণের ওপর পূর্ণ ও একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে এবং বাইরের কোনও রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের অধীন নয়। এর অর্থ হলো, রাষ্ট্রটি অভ্যন্তরীণভাবে নিজের আইন, প্রশাসন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে সম্পূর্ণ স্বাধীন; বাহ্যিক কোনো শক্তির নিয়ন্ত্রণ বা অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না।
Rod Hague ও Martin Harrop তাদের Comparative Government and Politics: An Introduction গ্রন্থে সার্বভৌমত্বকে সংজ্ঞায়িত করেছেন “কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উৎস, যা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়” হিসেবে। Andrew Heywood তার Politics বইয়ে বলেন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হলো “একটি ভূ-সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক একক, যা স্বাধীন এবং নিজস্ব জনগণ ও ভূখণ্ডের ওপর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব রাখে”।কিন্তু সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, আধুনিক বিশ্বে সার্বভৌমত্ব আপেক্ষিক হয়ে গেছে।
বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিক আইন, আঞ্চলিক জোট (যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন), অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, মানবাধিকার সুরক্ষার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা ও জাতিসংঘের মতো সংস্থার হস্তক্ষেপ একক রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্র তাত্ত্বিকভাবে তার সীমানার ভেতরে স্বাধীন, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বাণিজ্য চুক্তির কারণে অনেক সময় বাইরের মানদণ্ড মেনে চলতে বাধ্য হয়। তাই রাজনৈতিক বিজ্ঞানে সার্বভৌমত্ব মৌলিক হলেও, বাস্তবে এটি ক্রমশ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি ও বৈশ্বিক নীতির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে এসেছে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সার্বভৌমত্ব
জেমস রোজেনব্লুম তার The Study of Political Science (1971) বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতার সর্বোচ্চ উৎস, যা তাকে নিজস্ব আইন ও নীতিমালা প্রণয়নে স্বাধীনতা প্রদান করে।” সামুয়েল হান্টিংটন The Third Wave (1991) বইয়ে বলেছেন, “সার্বভৌমত্ব কেবল আইনগত ধারণা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা যা রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে সমান মর্যাদা দেয়।” মালকম শ’র International Law (2017) এ বলেন, “সার্বভৌমত্বের অর্থ হলো একটি রাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ছাড়া তার নিজস্ব স্বায়ত্তশাসন।”
প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক তাত্ত্বিকদের উক্তি;
জ্যান বডিন (Jean Bodin), আধুনিক সার্বভৌমত্ব তত্ত্বের জনক, বলেছেন-
Sovereignty is the absolute and perpetual power of a republic.
কার্ল শমিট (Carl Schmitt), প্রখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, বলেছেন-
Sovereign is he who decides on the exception.
হান্না আরেন্ত (Hannah Arendt), The Origins of Totalitarianism এ বলেছেন-
Sovereignty means independence from interference.
বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিজ্ঞানে সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র আইনগত ক্ষমতা নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতা ও স্বাধীনতার পূর্ণ প্রতীক। বডিনের মতে, এটি অপরিবর্তনীয় ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা। কিন্তু আধুনিক বাস্তবে কার্ল শমিটের বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শাসককে কখনো ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। আরেন্ত বলেন, সার্বভৌমত্ব মানে অন্য বাহ্যিক শক্তির হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীনতা, যা আজকের বিশ্বায়িত বিশ্বে ক্রমশ সীমিত হচ্ছে। রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি ও বিশ্বব্যাপী নীতির সঙ্গে নিজেদের সার্বভৌমত্বের কিছু অংশ শর্তসাপেক্ষে দায়বদ্ধ করছে।
আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে সার্বভৌমত্ব
মালকম শ’র (Malcolm Shaw), International Law এ সার্বভৌমত্বের তিন দিক তুলে ধরা হয়েছে—অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব (নিজেদের জনগণ ও ভূখণ্ডের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ), বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব (অন্য রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে স্বাধীনতা), এবং আইনি স্বীকৃতি (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বৈধতা)।
রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য Montevideo Convention (1933) অনুসারে চারটি শর্ত প্রয়োজন: স্থায়ী জনগণ, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, কার্যকর সরকার, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা। এসব না থাকলে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের চোখে স্বীকৃত হবে না এবং তার সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
শ’র বিশ্লেষণে স্পষ্ট, সার্বভৌমত্ব কেবল অভ্যন্তরীণ আইনি ক্ষমতা নয়, এটি আন্তর্জাতিক আইনেরও ভিত্তি। রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা মেনে চলার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে, ফলে সার্বভৌমত্ব একটি নমনীয় ও প্রগতিশীল ধারণা হিসেবে বিবেচিত।
সংবিধানের অবর্তমানে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ও বাংলাদেশের স্বীকৃতির গুরুত্ব
কোনো দেশের সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং শাসনব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তি হলেও, যদি কোনো কারণে সংবিধান বাতিল বা স্থগিত হয়, তবুও আন্তর্জাতিক আইন ও অন্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি সেই দেশের সার্বভৌমত্বের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সংবিধান না থাকলেও একটি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি দিলে তার ভূখণ্ড, জনগণ এবং সরকারকে বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আইনের আওতায় রক্ষা পায়।
আইসিজে (আন্তর্জাতিক আদালত) এর বিভিন্ন মামলায় এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়েছে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৬ সালের Nicaragua v. United States মামলায় আইসিজে বলেছে, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সামরিক বা প্যারামিলিটারি হস্তক্ষেপ, বিদ্রোহী বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ বা প্রশিক্ষণ দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন। এই রায় থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনে বেআইনি, ফলে বাংলাদেশ আইনি সুরক্ষা পায়।
১৯৪৯ সালের Corfu Channel মামলায় আইসিজে নির্ধারণ করেছে যে, রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের জলসীমা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে এবং অন্য দেশের নিরাপত্তা সম্মান করতে হবে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার ক্ষেত্রে UNCLOS চুক্তি ও এই মামলার আদর্শ অনুসারে দেশের জলসীমার সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক আইনে সুরক্ষিত।
আরও পড়ুন : বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব ও সংস্কারের ভবিষ্যৎ
২০০৫ সালের DRC v. Uganda মামলায় কঙ্গোর ভূখণ্ড দখলের জন্য উগান্ডাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যা স্পষ্ট করে যে অন্য দেশের সামরিক বাহিনী কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই উপস্থিত থাকলে তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এই রায় বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে দেশের অধিকার নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের Bangladesh v. Myanmar (ITLOS ২০১২) ও Bangladesh v. India (PCA ২০১৪) মামলাগুলো আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে দেশের জলসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে। এই সাফল্য দেখায় যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও আইন রক্ষা করতে পারে এমনকি সংবিধানের অনুপস্থিতিতেও।
সংবিধানের অভাব হলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও আইসিজে রায়সমূহ দেশের সার্বভৌমত্বের বহিঃস্থ সুরক্ষা দেয়। দেশের অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষা দায়িত্ব অবশ্যই সংবিধানের আওতায় হলেও, আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে অন্য দেশের অবৈধ হস্তক্ষেপ রোধ করা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধান অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজ করে, আর আন্তর্জাতিক আইনি আদর্শ ও অন্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বহিঃস্থ সুরক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ করে। এই দ্বৈত সুরক্ষা ব্যবস্থা দেশের সার্বভৌমত্বকে সর্বাঙ্গীন রূপে রক্ষা করে।
সংবিধান বাতিলের আইনি ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট
আমেরিকার দৃষ্টিকোণ
আমেরিকার সংবিধান বাতিল বা স্থগিতকরণ অত্যন্ত কঠিন ও জটিল বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বাতিল বা স্থগিত করা যায় না কোনও একক শাসক বা সরকারের মাধ্যমে। ১৮০৩ সালের Marbury v. Madison মামলার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করেছে যে সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন, এবং এর বিরুদ্ধে কোনো আইন বা আদেশ অগ্রাহ্য হবে। সংবিধান সংশোধন সম্ভব হলেও (আর্টিকেল V এর মাধ্যমে), পুরো সংবিধান বাতিলের কোনও বিধান নেই।
আর্টিকেল V: সংশোধনের আইনগত প্রক্রিয়া
আর্টিকেল V হলো আমেরিকার সংবিধানের সেই অংশ যেখানে সংশোধনের নিয়মাবলী নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দুটি ধাপ রয়েছে:
১. সংশোধনের প্রস্তাব
সংশোধনী প্রস্তাব দিতে পারে—
কংগ্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য (House of Representatives ও Senate উভয়ের সমন্বয়ে), অথবা
রাজ্যগুলো একত্রে (৩৪টির দুই-তৃতীয়াংশ রাজ্য) একটি জাতীয় সাংবিধানিক সম্মেলনের ডাক দিয়ে।
২. সংশোধনকে স্বীকৃতি ও গৃহীত ঘোষণা করা
প্রস্তাবিত সংশোধনীর জন্য দরকার হয় রাজ্যগুলোর তিন-চতুর্থাংশের (বর্তমানে ৩৮টি রাজ্য) অনুমোদন, যা রাজ্য আইনসভাগুলোর মাধ্যমে অথবা রাজ্য সম্মেলনের মাধ্যমে হতে পারে।
সংবিধান বাতিল বা স্থগিতকরণের অসাধ্যতা
এই প্রক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, পুরো সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করার জন্য কোনও সরাসরি বিধান নেই। সংবিধান বাতিল বা স্থগিতকরণ মানে দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলা, যা দেশীয় আইন-শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। অর্থাৎ, আমেরিকায় সংবিধান বাতিল করা আইনত অসম্ভব এবং সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে সংবিধানের সর্বোচ্চত্ব রক্ষা করা হয়।
ভারতের দৃষ্টিকোণ
ভারতের সংবিধানও সর্বোচ্চ আইন হিসেবে বিবেচিত এবং সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করার বিষয় কঠোর নিয়ন্ত্রণে। ১৯৭৩ সালের Kesavananda Bharati v. State of Kerala মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট “Basic Structure Doctrine” প্রতিষ্ঠা করেছে, যার মাধ্যমে বলা হয়েছে সংসদ সংবিধানের সংশোধন করতে পারবে, কিন্তু তার মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করতে পারবে না। সংবিধান বাতিল বা তার মূল কাঠামো পরিবর্তন মানে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত করা, যা গ্রহণযোগ্য নয়।
Asma Jilani v. Government of Punjab (1972) মামলায় পাকিস্তানের সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংবিধান বাতিলের বিরোধিতা করে ভারতের আদালত বলেছে, সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংবিধান বাতিল অবৈধ এবং জনগণের সার্বভৌম অধিকার সংবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ভঙ্গ করা যায় না।
আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলার প্রেক্ষাপট
১৯৮৯ সালের এই মামলাটি বাংলাদেশের উচ্চতম আদালতে উঠেছিল। মামলাটির মূল বিষয় ছিল সংবিধানের সংশোধনী কতটা বিধিসম্মত এবং সেগুলো কি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত হানতে পারে কি না। দেশের সংবিধানের ধারাবাহিক সংশোধন ও ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্ন মাথায় রেখে এই মামলার গুরুত্ব অপরিসীম।
মামলার ফলাফল ও গুরুত্ব
হাইকোর্ট প্রথমবারের মতো স্বীকার করে যে, বাংলাদেশের সংবিধানের কিছু মৌলিক কাঠামো বা ভিত্তি রয়েছে যা সংসদ ক্ষমতাসীন হলেও সংশোধন করতে পারবে না। আদালত ঘোষণা করে যে, কোনও সংশোধনী যদি এই মৌলিক কাঠামোর বিরুদ্ধ যায়, তাহলে তা অবৈধ এবং সংবিধানের বিরুদ্ধে গণ্য হবে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সংবিধানের অতিরিক্ত ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা যায় এবং দেশের মৌলিক সাংবিধানিক আদর্শ রক্ষা পায়।
সংক্ষেপে, আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো “বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন” প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নীতির ফলে নিশ্চিত হয় যে, কোনো সংবিধান সংশোধনী দেশের মূল গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক আদর্শকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না।
মামলার বিস্তারিত ও “বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন” এর ব্যাখ্যা
১৯৮০ ও ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা প্রায় বার বার সংশোধন করা হচ্ছিলো, যা অনেক সময় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি বা কিছু প্রতিষ্ঠান দুর্বল করার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছিল। এর ফলে প্রশ্ন ওঠে, সংবিধানের সংশোধনের কি কোনো সীমা থাকা উচিত? সংসদ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দেশের মূল কাঠামো বা আদর্শ নষ্ট করতে পারবে কি না?
এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৮৯ সালে আনোয়ার হোসেন চৌধুরী মামলাটি হাইকোর্টে ওঠে যেখানে আদালত নির্ধারণ করে যে সংবিধানের কিছু মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তনীয়। অর্থাৎ, কোনো সংসদীয় সংশোধনী যা এই মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা অবৈধ।
এই নীতিকে “বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন” বলা হয়, যা প্রথম প্রবর্তিত হয়েছিল ভারতের Kesavananda Bharati v. State of Kerala মামলায় (১৯৭৩)। বাংলাদেশে এই নীতির প্রতিষ্ঠা দেশের সংবিধান রক্ষা এবং সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপরোক্ত মামলাগুলোর প্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয় যে, সংবিধানের কোনো অংশ বাতিল বা পরিবর্তন করা গেলেও সেটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে হতে হবে। পুরো সংবিধান বাতিল করা বা তার মূল কাঠামো ভাঙা মানে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সংকট, যা রাজনৈতিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের এই নীতিমালা আন্তর্জাতিক আইনের Montevideo Convention এর শর্ত এবং মালকম শ’র International Law বইয়ের বিশ্লেষণের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ আন্তর্জাতিক আইনে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব মানে তার নিজস্ব কার্যকর সরকার, স্থায়ী জনগণ, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষমতা।
লেখক: মোরশেদ কামাল; শিক্ষানবিশ আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম।