হাসানুর রহমান
হাসানুর রহমান

ই-রিটার্নের যুগে বাংলাদেশ: কর ব্যবস্থায় নতুন সম্ভাবনা ও বাস্তবতা

হাসানুর রহমান : বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে। কর ব্যবস্থাও তার বাইরে নয়। একসময় যেখানে আয়কর রিটার্ন দাখিল মানেই ছিল ফাইলের পাহাড়, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো ও সময় অপচয়ের আশঙ্কা- সেখানে এখন মাত্র কিছু ক্লিকেই সম্পন্ন হচ্ছে সেই কাজ। বাংলাদেশে চালু হওয়া “ই-রিটার্ন” ব্যবস্থা কর ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি কেবল সময় ও খরচ সাশ্রয় করে না, বরং কর ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ, আধুনিক ও জবাবদিহিমূলক করে তুলতে সহায়তা করছে। তবে প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও যুক্ত থাকে। এই কলামে ই-রিটার্নের সুবিধা, সীমাবদ্ধতা, সম্ভাবনা ও করদাতা ও রাষ্ট্রের করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

 ই-রিটার্নের গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাসমূহ

১. সময় ও খরচ সাশ্রয়: আগে রিটার্ন দাখিল করতে কর অফিসে গিয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হতো। এখন ঘরে বসেই কম্পিউটার ব্যবহার করে রিটার্ন দাখিল করা সম্ভব। এতে যাতায়াত, পরিবহন, ফটোকপি ও অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয় অনেক কমে গেছে।

২. স্বচ্ছতা ও নিরাপদ রেকর্ড: ডিজিটাল রিটার্ন দাখিলে তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত হয়, যা ভবিষ্যতে যাচাই, সংশোধন ও পর্যালোচনায় সহায়ক। একই সঙ্গে এটি দুর্নীতির সুযোগ হ্রাস করে এবং করদাতার আস্থা বাড়ায়।

৩. সার্বক্ষণিক (২৪/৭) সেবা: ই-রিটার্নের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি নির্দিষ্ট অফিস সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দিন-রাত যেকোনো সময় রিটার্ন দাখিল করা যায়।

৪. পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি: কাগজ ব্যবহার কম হওয়ায় এটি পরিবেশবান্ধব। ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন টেকসই উন্নয়নের অংশ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।

৫. তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি স্বীকার: রিটার্ন জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পাওয়া যায়, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি বৈধ ও স্বীকৃত দলিল হিসেবে কাজ করে।

৬. ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্য পূরণে সহায়ক: সরকারের “ডিজিটাল বাংলাদেশ” কর্মসূচির অংশ হিসেবে কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ই-রিটার্ন সে লক্ষ্যে বাস্তবায়িত সফল উদ্যোগ।

বর্তমান বাস্তবতায় কিছু চ্যালেঞ্জ

১. ডিজিটাল দক্ষতার অভাব: দেশের একটি বড় অংশের করদাতা—বিশেষ করে বয়স্ক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী—ডিজিটাল প্রযুক্তিতে এখনো দক্ষ নন। ফলে ই-রিটার্ন ব্যবস্থায় অংশ নেওয়ায় তাঁদের দ্বিধা থাকে।

২. সার্ভারের সীমাবদ্ধতা: রিটার্ন জমাদানের শেষ সময় ঘনিয়ে এলে এনবিআরের সার্ভার ধীর হয়ে পড়ে বা বিকল হয়। এতে সময়মতো রিটার্ন দাখিলে সমস্যা দেখা দেয়।

৩. বাংলা ভাষার ঘাটতি: ই-রিটার্ন পোর্টালের ইন্টারফেস ইংরেজি নির্ভর হওয়ায় অনেক করদাতা বুঝতে ব্যর্থ হন, যা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

৪. পর্যাপ্ত সহায়তা না পাওয়া: যথাযথ হেল্পডেস্ক বা সহায়তা কেন্দ্র না থাকায় অনেক করদাতা ব্যক্তিগতভাবে সঠিক পরামর্শ পান না। এতে করে বিভ্রান্তি ও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

৫. আইনগত ঝুঁকি: রিটার্ন সময়মতো না দিলে আয়কর আইনের আওতায় কর অব্যাহতি, বিনিয়োগ রেয়াত, ও সুদ মওকুফের সুযোগ হারিয়ে যায়। এ ছাড়া, কর নির্ধারণের ঝুঁকিও থাকে।

৬. সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি: ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। করদাতার গোপনীয় তথ্য যেন হ্যাক বা ডেটা লিকের শিকার না হয়, সেজন্য সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা আবশ্যক।

 করদাতাদের জন্য করণীয়

প্রযুক্তি বিষয়ে সচেতনতা ও আগ্রহ বাড়ানো: নতুন প্রযুক্তি শেখার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। এনবিআরের প্রকাশিত নির্দেশিকা, ইউটিউব টিউটোরিয়াল, ওয়েবিনার ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

বাৎসরিক আয় শূন্য, ব্যয় শূন্য, সম্পদ শূন্য বাস্তবে এমন মানুষ পাওয়া যায় না। তবুও অনেক নন-প্রফেশনাল বা কম্পিউটার দোকানদার আয়কর ফাইলের সব ঘরে শূন্য ইনপুট দিয়ে “জিরো রিটার্ন” করে দেন।

 জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) সতর্ক করছে —

আয়কর আইন, ২০২৩ অনুযায়ী আয়, ব্যয়, সম্পদ শূন্য দেখিয়ে “জিরো রিটার্ন” নামে কোনো রিটার্ন দাখিলের বিধান নেই। মিথ্যা বা আয়, ব্যয়, সম্পদ শূন্য তথ্য দিয়ে রিটার্ন দাখিল দণ্ডনীয় অপরাধ। সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।  ভুল বা ভূয়া রিটার্ন দিলে অডিটের ঝুঁকি বাড়ে।

আপনার করণীয় — প্রকৃত আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের তথ্য সঠিকভাবে দিন। কোনো তথ্য গোপন করবেন না। নিজে না পারলে একজন প্রফেশনাল কর আইনজীবীর সহযোগিতা নিন।  মনে রাখবেন — কর ফাঁকি বা মিথ্যা রিটার্ন আইনের চোখে সমান অপরাধ।

আজ ভুল করলে কাল বড় বিপদে পড়তে হবে।

 পেশাদার সহায়তা গ্রহণ: যাঁরা নিজেরা রিটার্ন প্রস্তুত করতে পারছেন না, তাঁদের উচিত অভিজ্ঞ আয়কর পরামর্শদাতা বা ট্যাক্স প্র্যাকটিশনারের সহায়তা নেওয়া।

 সময়সীমার মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করা: রিটার্নের সময়সীমার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগে থেকেই তথ্য ও কাগজপত্র প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন।

 নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য গ্রহণ: ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য এড়িয়ে চলা জরুরি। এনবিআর, বার অ্যাসোসিয়েশন, কিংবা অনুমোদিত আয়কর পরামর্শকদের কাছ থেকে তথ্য গ্রহণ করাই নিরাপদ।

সরকারের নিকট প্রত্যাশিত পদক্ষেপ

  • বাংলাভাষী ও ব্যবহারবান্ধব ইন্টারফেস তৈরি।
  • প্রতিটি কর অফিসে ডিজিটাল হেল্প ডেস্ক চালু।
  • সার্ভারের সক্ষমতা বাড়ানো ও ব্যাকআপ নিশ্চিত।
  •  সাধারণ করদাতার জন্য সহজ নির্দেশিকা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
  •  প্রবীণ ও প্রান্তিক করদাতার জন্য সহায়ক ট্যাক্স ক্যাম্প বা প্রণোদনা ব্যবস্থা।
  •  সাইবার নিরাপত্তা জোরদারকরণে বিশেষ বাজেট বরাদ্দ ও আইটি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ।

ই-রিটার্ন নিঃসন্দেহে একটি আধুনিক, সময়োপযোগী এবং জনবান্ধব উদ্যোগ। তবে এ ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে কেবল প্রযুক্তি নয়, মানুষের সক্ষমতা ও সচেতনতার ওপরও জোর দিতে হবে। এটি শুধু কর আহরণ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতা, ডিজিটাল দক্ষতা এবং নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতের এক অনন্য পথ। সরকার, করদাতা ও পেশাজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে এই ডিজিটাল রূপান্তর কেবলমাত্র কর সংগ্রহ বৃদ্ধিই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক : হাসানুর রহমান; আয়কর আইনজীবী।