ড. মুহাম্মদ ইউনুস নেতৃত্বাধীন অন্তরবর্তী সরকার ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি কাঠামোর সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তার মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার অন্যতম। রাষ্ট্রের তিনটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগের ভূমিকা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিকাশ ও টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগের উপর জনগণের অনাস্থা শাসন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল করে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জনগণের অধিকার রক্ষা, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা এবং জনগণের জন্য বিচার প্রাপ্তিকে সহজ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ৩ অক্টোবর আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনে পাঁচজন সাবেক বিচারক, একজন আইনজীবী, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও একজন ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গত জানুয়ারীতে ৩৩ অধ্যায়ের ৩৫২ পৃষ্ঠার সংস্কার সুপারিশ সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবেদন আইন ও বিচার বিভাগ এবং প্রধান উপদেষ্টার নিকট হস্তান্তর করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম সংস্কার সুপারিশ সমূহ হলো পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, প্রধান বিচারপতি ব্যতীত সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠন, দেশের সব প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন, জেলা পর্যায়ে বাণিজ্যিক আদালত স্থাপন, উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত স্থাপন ও স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন।
সরকার ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এবং কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এইসব সংস্কার পদক্ষেপ সমূহ নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, অনেকেই মনে করেন নিয়মিত প্র্যাকটিশনার আইনজীবীদের মতামত না নেওয়ায় সংস্কার সুপারিশে সংস্কারের প্রকৃত উদ্দেশ্য তুলে ধরতে কমিশন ব্যর্থ হয়েছে।
আরও পড়ুন : আইন পেশা বনাম রাজনীতি
সুপ্রীম কোর্টের অনেক সিনিয়র আইনজীবীর ধারণা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিলের অধীনে বিচারক নিয়োগের বিষয়টি যথাযথ হয়নি। এর ফলে আইন পেশায় যারা সুনামের সাথে ভালো করছেন তারা কমিশনের প্রস্তাবিত প্রক্রিয়ায় বিচারক হতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন এবং রাষ্ট্র যোগ্য বিচারক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামও ইতোমধ্যে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিচারক নিয়োগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং কর্মসূচি পালন করেছেন। আদালত প্রাঙ্গনের অনেকেই মনে করছেন এই কারনে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগের জন্য জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিলের অধীনে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত বিচারক নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি।
দেশের সকল প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগে স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যেহেতু সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের সকল বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে সুপ্রীমকোর্ট সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে দেয় সেহেতু পুনরায় বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন করা হলে বিষয়টি আদালত অবমাননা হবে। সুপ্রীম কোর্টের একাধিক সিনিয়র আইনজীবী ইতোমধ্যে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন কমিশনের এই প্রস্তাবকে তারা সমর্থন করেননা, প্রয়োজনে তারা “কনটেম্পট অব কোর্ট” হিসেবে বিষয়টি আদালতের নজরে নিয়ে আসবেন।
উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপনের বিষয়টিও অধস্তন আদালতের আইনজীবীরা ইতিবাচকভাবে নেয়নি। অধস্তন আদালতের আইনজীবীরা মনে করে জেলা বার গুলোতেই বর্তমানে পর্যাপ্ত দক্ষ আইনজীবীর সংকট রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপন হলে এই সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে এবং অনেক উপজেলা আদালত দক্ষ আইনজীবী শূন্য থাকবে। এরফলে বিচার প্রার্থীরা ভোগান্তির সম্মুখীন হবে, আদালতে স্থানীয় দালাল ও টাউটদের দৌড়াত্ব এবং ক্ষমতাশীন দলের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।
আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর বিষয়েও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই অধ্যাদেশের ফলে মামলা জট নিরসনের পরিবর্তে মামলা জট বৃদ্ধি পাবে, বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। অনেক ক্ষেত্রে মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত ও সাক্ষী নষ্ট হবে, সর্বোপরি বিচার প্রার্থীর ন্যায় বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শঙ্কা তৈরি হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে বলা যায়, বিচার বিভাগ সংস্কার প্রস্তাব সমূহ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিছু বিষয়ে অধ্যাদেশ প্রণয়ন হলেও ভবিষ্যতে এসব বলবৎ থাকবে কিনা সেটা নিয়েও সংশয় থাকছে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে রয়েছে বিচার বিভাগের স্টেক হোল্ডারদের যথাযথভাবে সংস্কার কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়া, কমিশনে আইনজীবীদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধির অনুপস্থিতি, সংস্কার সুপারিশ সমূহ নির্ধারনের ক্ষেত্রে আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের মতামত গ্রহণ না করা এবং প্রস্তাব সমূহের বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষা পরিচালনা না করা।
এইসব বিষয় পর্যালোচনা করে বলা যায় কমিশন বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবিত বিষয় সমূহ চূড়ান্ত সংস্কার সুপারিশ না হয়ে প্রাথমিক মতামত হওয়া উচিত ছিলো। আশাকরি সরকার ভবিষ্যতে কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়নের পূর্বে বিচার বিভাগের স্টেকহোল্ডার, আইনজীবী, বিচার প্রার্থীদের মতামত গ্রহণ ও মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষা পরিচালনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন। অন্যথায় বিচারাঙ্গনে সংকট তৈরি হবে এবং সংস্কারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
লেখক : আইনুল ইসলাম বিশাল; অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।