রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় এসেছে পি আর (Proportional Representation) ইলেকশন বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনব্যবস্থা যা বিশ্বের ছোট গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ । গণতান্ত্রিক উন্নয়ন কিংবা নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের আড়ালে এই প্রস্তাব আসলেও বাস্তবে এটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ধরনের দেউলিয়াত্ত্ব ও আত্মসমর্পণ হিসেবে প্রতীয়মান হয় রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকার নেই বললেই চলে।
কেন পি আর ইলেকশনকে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ত্ব বলা হচ্ছে?
বাংলাদেশের সংবিধান জনগণের সার্বভৌমত্বের নীতিকে মূল ভিত্তি হিসেবে স্বীকার করেছে preamble বা প্রস্তাবনা ও অনুচ্ছেদ ৭ এর মাধ্যমে। জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন সরাসরি —এই নীতিই সংবিধানের স্বীকৃতি। বর্তমান একক সদস্যীয় আসনভিত্তিক বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থায় (First-Past-the-Post) সেই সুযোগ নিশ্চিত করে যেখানে ভোটার তার যোগ্য প্রার্থীকে সরাসরি বেছে নেন এবং তার কাছে জবাবদিহিতা দাবি করতে পারেন। কিন্তু আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) ব্যবস্থায় ভোটার সরাসরি প্রার্থীকে ভোট দেন না বরং তিনি একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন;পরবর্তীতে সেই ভোটের অনুপাতে দল সংসদে আসন পায় এবং প্রার্থী মনোনীত হয় দলীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। এর ফলে—
-
ভোটার-প্রতিনিধির সরাসরি সম্পর্ক ক্ষুণ্ন হয় – সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও PR পদ্ধতিতে জনগণ জানতেও পারবেন না তার এলাকার এমপি কে হবেন ভবিষ্যৎ এ। এতে প্রতিনিধি আর জনগণের মধ্যে দায়বদ্ধতা দুর্বল হয়ে যায়,প্রতিনিধি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ না থেকে দলের কাছে দায়বদ্ধ থাকে।
-
দলীয় ক্ষমতার একচ্ছত্রতা বাড়ে – বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আগে থেকেই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। দলীয় প্রধান ও কেন্দ্রীয় কমিটি কার্যত মনোনয়ন নিয়ন্ত্রণ করেন প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে। PR পদ্ধতিতে এই ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত হবে কেন্দ্রে। জনপ্রিয়তা নয় বরং অন্ধ আনুগত্য হবে প্রার্থী হওয়ার মূল যোগ্যতা।
-
সংসদের দায়বদ্ধতা সংকুচিত হয় – PR ব্যবস্থায় নির্বাচিত সদস্যরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না বরং দলীয় নেতৃত্বের কাছে থাকেন কুন্ঠাবোধ হয়ে। এতে সংসদ কার্যত হয়ে ওঠে দলীয় আনুগত্যের প্রতিচ্ছবি, কখনোই জনগণের প্রতিনিধিত্ব নয়।
-
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ – আমাদের সাংবিধানিক ইতিহাসে স্থানীয় জনসম্পৃক্ততা (যেমন—মুক্তিযুদ্ধোত্তর গণভোট, ইউনিয়ন পরিষদ ও সংসদ নির্বাচন) জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে সুদীর্ঘকাল ধরে । PR সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ থেকে শিক্ষা কেন PR একটি ভ্রান্ত মতবাদ
ইসরায়েল: পুরোপুরি PR পদ্ধতি চালু থাকায় প্রায় সবসময়ই ভাঙা ভাঙা জোট সরকার হয়েছে,কখনোই সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকে প্রধান্য দেয় নি। জনগণের প্রত্যক্ষ দায়বদ্ধতা না থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
শ্রীলঙ্কা: PR চালুর পর স্থানীয় জনগণ ও প্রতিনিধিদের সম্পর্ক দুর্বল হয়েছে ধীরে ধীরে। সংসদ সদস্য নির্ধারণে অর্থবল ও দলীয় লবিং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে লংকান রাজনীতিতে।
জার্মানি: এখানে PR ব্যবস্থাকে সরাসরি আসনের সঙ্গে মিশ্র আকারে প্রয়োগ করা হয়েছে ফলে ভারসাম্য কিছুটা বজায় থাকে। তবে বাংলাদেশে সেই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুটোর কোনটিই নেই।
ইতালি
পিআর ব্যবস্থায় প্রায় প্রতিবারই দুর্বল জোট সরকার হয়েছে ইতালির রাজনীতিতে। অল্প ভোট পাওয়া ছোট দলগুলো জোটে বড় দলকে ব্ল্যাকমেইল করত, ফলে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে যেত দেশের স্বার্থে। একসময় প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে ৫০টিরও বেশি সরকার পরিবর্তন হয়-যা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের বহি প্রকাশ।
নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়াম
এখানে ভোটাররা দলের জন্য ভোট দেন, সরাসরি প্রার্থীর জন্য নয়-যা Sound Democracy এর বিরোধিতা করে।প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ সরাসরি তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে জবাবদিহিতা আশা করে। কিন্তু পিআরে প্রার্থী নির্ধারণ করে দলীয় সিদ্ধান্ত, ফলে প্রতিনিধিরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে দায়বদ্ধ থাকে না।প্রতিনিধিত্ব হয়ে দাঁড়ায় অন্ধ দলমুখী, জনকল্যাণমুখী নয়।
সাংবিধানিক দৃষ্টিতে ফলাফল
বাংলাদেশের সংবিধানের মূল হাতিয়ার হলো—জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। PR নির্বাচন চালু হলে সেই ক্ষমতা জনগণের হাত থেকে সরে গিয়ে কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে আজীবনের জন্য। এটি সংবিধানের basic structure বা মৌলিক কাঠামো (Kesavananda Bharati vs State of Kerala মামলার সিদ্ধান্ত)—গণতন্ত্র, জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্বমূলক দায়বদ্ধতার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। অতএব, বাংলাদেশের বাস্তবতায় PR নির্বাচন প্রবর্তন মানে শুধু একটি নির্বাচনী পদ্ধতির পরিবর্তন নয় বরং সংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা ভাঙনের এক পদ্ধতি এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ত্বের চরম স্বীকারোক্তি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থায়।
বাংলাদেশের জন্য কোন পথ?
বাংলাদেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে কেবলমাত্র দ্রুত নির্বাচন আয়োজন যথেষ্ট নয় বরং প্রয়োজন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি। গণতন্ত্রের মৌলিক তত্ত্ব অনুযায়ী—জন লক বলেছিলেন শাসকের বৈধতা জনগণের সম্মতি থেকে আসে সরাসরি এবং রুশো তাঁর Social Contract-এ স্পষ্ট করেছেন যে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার একমাত্র উৎস হবে গণতন্ত্রের সুফল পেতে।
বাংলাদেশের সংবিধানও একই নীতি ধারণ করেছে—“সকল ক্ষমতা জনগণের নিকট ন্যস্ত থাকবে” (অনুচ্ছেদ ৭)। সুতরাং, যে কোনো নির্বাচনব্যবস্থা জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করলে তা সাংবিধানিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায় এবং সুদীর্ঘ সংগ্রামের আজকের এই বাংলাদেশকে একটি বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলবে।
এ কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার—
নির্বাচন কমিশনের প্রকৃত স্বাধীনতা – কমিশনকে সাংবিধানিক ক্ষমতায় শক্তিশালী ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে অতি দ্রুত
প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা – রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয়করণ থেকে মুক্ত করে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে সকল নাগরিকের জন্য
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট আয়োজন – যাতে প্রতিটি দল সমানভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে এবং জনগণ তাদের মত প্রকাশে নিশ্চিন্ত থাকে।এমন যেন না হয় তার মত প্রকাশই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে
দলীয় অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা – রবার্ট ডালের polyarchy ধারণা অনুসারে বহুমাত্রিক অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতার সুযোগ না থাকলে গণতন্ত্র স্থায়ী হতে পারে না কোন গণতান্ত্রিক দেশে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে তাই অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, স্বচ্ছ মনোনয়ন প্রক্রিয়া,জবাবদিহিতা ও নীতি নির্ধারণে সদস্যদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশে কোয়াশমেন্ট: তুলনামূলক বিচারনীতি ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
অতএব, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মতো অপ্রয়োজনীয় ও অজনপ্রিয় ব্যবস্থা প্রবর্তন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও দূরে সরিয়ে দেবে এবং দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য তা অস্বাস্থ্যকর । বরং জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার ও দায়বদ্ধতা বজায় রেখে একটি স্বাধীন, অংশগ্রহণমূলক,নিরপেক্ষ এবং তাত্ত্বিকভাবে সুসংহত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই হতে পারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথ।
আমরা বলতে পারি পি আর নির্বাচন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার বদলে জনগণকে আরও প্রান্তিক করবে, তাকে বানাবে পণ্য। বাংলাদেশের জন্য এটি গণতন্ত্রের বিকল্প নয় বরং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ত্ব ও প্রতিনিধিত্ব রাজনীতিতে অক্ষমতার প্রতিফলন। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ রক্ষায় এখনই দরকার জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা—কোনো কৃত্রিম পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া নয় যা বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
লেখক : ফাইজুল ইসলাম; প্রভাষক, আইন বিভাগ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি এবং এম.ফিল রিসার্চার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।