বাংলাদেশে বিচার বিভাগের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ২ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে Civil Courts (Amendment) Ordinance, 2025 জারি করেছেন। এতে ১৮৮৭ সালের Civil Courts Act সংশোধন করে ‘সহকারী জজ’ ও ‘সিনিয়র সহকারী জজ’ পদবি যথাক্রমে ‘সিভিল জজ’ ও ‘সিনিয়র সিভিল জজ’ হিসেবে পরিবর্তন করা হয়েছে।
রোববার (২ নভেম্বর) প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় এ অধ্যাদেশটি প্রকাশ করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ। অধ্যাদেশটি অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশটি প্রণয়ন করেন, কারণ সংসদ তখন ভেঙে যাওয়া অবস্থায় ছিল এবং জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল বলে রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয়।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ১৮৮৭ সালের Civil Courts Act–এর বিভিন্ন ধারা, যেমন section 3, 4, 13, 19, 21, 22, 23, 24, 25 ও 25A–এ থাকা “Assistant” শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়ে “Civil” হয়েছে। অর্থাৎ, এখন থেকে “Assistant Judge” বা “Senior Assistant Judge” এর পরিবর্তে “Civil Judge” ও “Senior Civil Judge” শব্দ দুটি ব্যবহৃত হবে।
ধারা ২৫A নতুনভাবে প্রতিস্থাপন
নতুন ধারা ২৫A–তে বলা হয়েছে,
যে কোনো প্রচলিত আইনে যদি Additional Judge, Subordinate Judge, Senior Assistant Judge বা Assistant Judge–এর উল্লেখ থাকে, তবে তা যথাক্রমে Additional District Judge, Joint District Judge, Senior Civil Judge বা Civil Judge হিসেবে গণ্য হবে।
অধ্যাদেশে রাষ্ট্রপতির পক্ষে স্বাক্ষর করেন ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ।
পদবি পরিবর্তনের পটভূমি
এর আগে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (BJSA) বিচারকদের পদবি পরিবর্তনের দাবিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠায়। এতে বলা হয়, “সহকারী জজ” ও “সিনিয়র সহকারী জজ” পদবি দুটি বিচারকদের মর্যাদা ও এখতিয়ারের যথার্থ প্রতিফলন ঘটায় না, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে।
অ্যাসোসিয়েশনের মতে, “সহকারী” শব্দটি আভিধানিকভাবে কোনো জজের সহকারী, প্রশিক্ষণার্থী বা সহায়তাকারীকে বোঝায়, যা বিচারিক স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অথচ সংবিধানের ১১৬(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এই বিচারকেরা সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করেন।
১৯৮৭ সালে “মুনসেফ” পদবি পরিবর্তন করে “সহকারী জজ” নামকরণ করা হয়েছিল বিসিএস অন্যান্য ক্যাডারের পদবির অনুকরণে। কিন্তু ২০০৭ সালে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর থেকে এই পদবি বিচার বিভাগের স্বাধীন সত্তার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।
চিঠিতে বলা হয়, “সহকারী” শব্দের কারণে বিচারপ্রার্থীরা প্রায়ই বিভ্রান্ত হন, অনেক সময় একজন ‘সহকারী জজ’ আদৌ বিচারক কি না, তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দেয়। ফলে বিচারকরা অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন।
অ্যাসোসিয়েশন প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করে, এই পদবি পরিবর্তনে সরকারের আর্থিক কোনো সংশ্লেষ নেই। কেবল একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে Civil Courts Act, 1887 সংশোধন করলেই আইনি কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন কার্যকর করা সম্ভব।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম ও মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়,
“সহকারী জজ” ও “সিনিয়র সহকারী জজ” পদবি যথাক্রমে “সিভিল জজ” ও “সিনিয়র সিভিল জজ” নামে পরিবর্তন করা হলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে আদালতের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পাবে, আর বিচারকদের মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য আরও দৃঢ় হবে।
রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে এই প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটায় বিচার বিভাগে ব্যাপক সন্তোষ প্রকাশ করেছে বিচারক মহল। অনেকে একে ‘বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষায় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

