রেদওয়ান আহমেদ
রেদওয়ান আহমেদ

অর্পিত সম্পত্তির ধারণা, ইতিহাস ও অবমুক্তকরণ প্রক্রিয়ার বাস্তবিক প্রেক্ষাপট

রেদওয়ান আহমেদ : মানব সভ্যতা অগ্রযাত্রার সবচেয় বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে যুদ্ধবিগ্রহ। আর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যুদ্ধকালীন সময় রচিত হয়েছে অনেক আইন। অর্পিত সম্পত্তি (যা পূর্বে শত্রু সম্পত্তি নামে ছিল) সংক্রান্ত আইনের উৎপত্তি ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সংঘটিত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। ১৯৬৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। যা ১৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

৬ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সরকার জরুরিকালীন অবস্থা ঘোষণা করে পাকিস্তান রক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৬৫ জারী করে এবং কতিপয় বিধি প্রণয়ন করে। ঐসব বিধি বলে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, যুদ্ধকালীন সময় কোন ব্যক্তি ভারতে গিয়ে থাকলে পাকিস্তানে অবস্থিত তার সকল ত্যক্ত সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসাবে পরিগণিত হবে এবং অধিগ্রহণ করা হবে।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি আদেশ দ্বারা বাংলাদেশ সরকার শত্রু সম্পত্তি সংক্রান্ত পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রণীত অধ্যাদেশ বলবৎ রাখে এবং ১৯৭৪ সালের ৪৫ ও ৪৬ নং আইন দ্বারা সমস্ত শত্রু সম্পত্তি সরকারের উপর ন্যস্ত হবে এবং তা অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে পরিচিত হবে মর্মে ঘোষণা করা হয়।

অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তকরণ প্রক্রিয়া

২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইন ২০০১ নামে নতুন একটি আইন পাশ করে। যার মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত ১৯৭৪ সালের আইনটি রহিত করা হয়। ২০০১ সালের আইনে বলা হয়, অর্পিত সম্পত্তি তালিকা ভুক্ত করার পর উক্ত সম্পত্তির প্রকৃত মালিক বা তার উত্তরাধিকারীগন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারে কাছে উক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন।

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইনটি ২০০১ সালে পাশ হলেও তখন অর্পিত সম্পত্তির কোন তালিকা প্রকাশ না করায় এবং উক্ত আইনে অবমুক্তির যথাযথ প্রক্রিয়া উল্লেখ না থাকায় অবমুক্তির প্রক্রিয়া তৎকালীন সময় শুরু করা যায়নি। পরবর্তীতে ২০১১ ও ২০১৩ সালে সরকার ২০০১ সালের অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইনটি ব্যাপক সংশোধন করে অবমুক্তির জন্য আবেদনের সময়সীমা, আবেদন প্রক্রিয়া, ট্রাইব্যুনাল ও আপীল ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ যাবতীয় বিষয় সংযুক্ত করে এবং অর্পিত সম্পত্তির তালিকা প্রকাশ করে।

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন সংশোধন আইন ২০১১ এর ৯ ধারায় অর্পিত ‘ক’ ও ‘খ’ তপসিল সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের বিধান করা হয়। যে সকল সম্পত্তি প্রত্যক্ষ ভাবে সরকারের দখলে আছে বা সরকার কর্তৃক লিজ দেওয়া আছে সেই সকল সম্পত্তি ‘ক’ তপসিলে এবং যে সকল সম্পত্তি সরকারের দখলে নাই বা সরকার কর্তৃক লিজ দেওয়া নাই কিন্তু বি.আর.এস জরীপে ১/১ নং খতিয়ান ভুক্ত সেই সকল সম্পত্তি ‘খ’ তপসিল হিসাবে অর্ন্তভূক্ত করে সারা দেশে মৌজা ভিত্তিক গেজেট প্রকাশ করা হয়।

আরও পড়ুন : পাচারের সম্পদ সন্ধান করবে অর্থঋণ আদালত

২০১১ সালের সংশোধনী দ্বারা ‘ক’ তপসিল ভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য তালিকা প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে এবং ‘খ’ তপসিল ভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য তালিকা প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে জেলা কমিটির নিকট আবেদনের বিধান করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইন পুনরায় সংশোধনী দ্বারা ‘ক’ তপসিল ভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য গেজেট প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে এবং উক্ত সময়ও অতিবাহিত হয়ে গেলে ২০১৩ সালের ৩১শে ডিসেম্বর এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরের সময় বর্ধিত করা হয় এবং ২৮(ক) ধারা সংযোজন করত ‘খ’ তফসিল বাতিল ঘোষনা করা হয়, একই সাথে ‘খ’ তপসিল ভুক্ত সম্পত্তি ভোগ দখল কারীদের বাতিলের গেজেট প্রকাশের ১ (এক) বছরের মধ্যে বৈধ প্রমানপত্র দাখিল স্বাপেক্ষে নিজ নিজ নামে হোল্ডিং খুলিয়া ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়।

‘ক’ তপসিলের গেজেট প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে বা ২০১৩ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে উক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য এর মালিক কর্তৃক মালিকানার দাবীর সমর্থিত দলিল পত্র সহ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করিলে ট্রাইব্যুনাল উক্তরূপ আবেদন প্রাপ্তির পর সরকারকে নোটিশ দিয়ে প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ এবং অনুসন্ধান প্রতিবেদন বিবেচনান্তে রায় প্রদান করবেন। রায় প্রদানের ৪৫ দিনের মধ্যে রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপীল ট্রাইব্যুনালে আপীল দায়ের করতে পারবেন। আপীল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত রায় হিসাবে গণ্য হবে।

আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে কোন আপীল বা রিভিশন দায়ের করা যাবে না। ট্রাইব্যুনাল বা আপীল ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক চূড়ান্ত ডিক্রি হওয়ার ৪৫ দিন পর ট্রাইব্যুনাল উক্ত রায় ডিক্রি বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসক এর নিকট প্রেরণ করবেন। ডিক্রিকৃত সম্পত্তি অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকলে জেলা প্রশাসক তাকে উচ্ছেদ ক্রমে ডিক্রি প্রাপককে দখল বুঝিয়ে দিবেন এবং তৎপরবর্তী ৩০ দিনে মধ্যে রাজস্ব অফিস রেকর্ড অব রাইটস সংশোধন করে এতে ডিক্রি প্রাপকের নাম অন্তর্ভূক্ত (মিউটেশন) করার ব্যবস্থা করবেন।

অ-দাবীকৃত সম্পত্তির ক্ষেত্রে করনিয়

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন সংশোধন আইন ২০১৩ এর ১০(১ক) ধারা অনুসারে ‘ক’ তপসিল ভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরর সর্বশেষ সময় ছিল ২০১৩ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। উক্ত সময়ের মধ্যে ‘ক’ তপসিল ভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন না করলে বা আবেদন করলেও তা প্রমাণে ব্যর্থ হলে উক্ত সম্পত্তি সরকারী সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হবে এবং সরকার উক্ত সম্পত্তি বেচাবিক্রি বা লিজি প্রদান করতে পারবেন।

এক্ষেত্রে ‘ক’ তপশিল ভুক্ত যে সকল সম্পত্তি তামাদির নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অবমুক্তির জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হয় নাই, উক্ত সম্পত্তির বৈধ দাবিদার এবং দখলদার ব্যক্তি দেওয়ানী আদালতে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনায় মোকদ্দমা দায়ের বা হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করতে পারেন। যাতে করে অ-দাবীকৃত উক্ত সম্পত্তি সরকার অন্যত্র বেচাবিক্রি বা দখল হস্তান্তর করতে না পারে।

‘খ’ তপসিল ভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির গেজেট প্রকাশের ১ (এক) বছরের মধ্যে উক্ত সম্পত্তি দাবিদার ব্যক্তি কর্তৃক বৈধ দলিলপত্র উপস্থাপন পূর্বক নিজ নামে নামজারী করে নেওয়ার জন্য আবেদন না করলে উক্ত সম্পত্তির স্বত্ব সরকারের উপর ন্যস্ত হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ঠ দাবিদার ব্যক্তি দেওয়ানী আদালতে স্বত্ব ঘোষণার প্রতিকার প্রার্থনায় মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন।

লেখক : রেদওয়ান আহমেদ; অ্যাডভোকেট, জেলা জজ আদালত, শরীয়তপুর। E-mail: redwanahmedlaw.bd@gmail.com