লাইলাতুল ফেরদৌস
লাইলাতুল ফেরদৌস

প্রায় চার দশক পর বিভ্রান্তির অবসান: সহকারী জজ থেকে এখন সিভিল জজ

লাইলাতুল ফেরদৌস : বাংলাদেশের দেওয়ানি আদালত ব্যবস্থায় বহুল বিতর্কিত একটি পদবি ছিল ‘সহকারী জজ’। নামের মধ্যেই একটি ভুল বোঝাবুঝি লুকিয়ে ছিল দীর্ঘ ৩৮ বছর। ‘সহকারী জজ’ শুনলে সাধারণ মানুষ মনে করতেন তিনি কোনো সিনিয়র জজের ব্যক্তিগত সহকারী বা প্রশিক্ষণরত কেউ। অথচ বাস্তবে তিনিও একজন পূর্ণাঙ্গ বিচারক, যিনি স্বাধীনভাবে দেওয়ানি মামলা, বিশেষ করে জমি জমার মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ বিচার করেন।

বহু বছর ধরে এই বিভ্রান্তি বিচারককে যেমন বিব্রত করেছে, তেমনি সাধারণ বিচারপ্রার্থীর মাঝেও আদালতের প্রতি অযথা সন্দেহ ও অনাস্থা তৈরি করেছে।

অবশেষে সেই ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলো। ১৯৮৭ সালের সহকারী জজ নামকরণ, দীর্ঘ ৩৮ বছর পর পরিবর্তন হয়ে “সিভিল জজ”

গত ২ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে জারি করা Civil Courts (Amendment) Ordinance, 2025 এর মাধ্যমে ‘সহকারী জজ’ ও ‘সিনিয়র সহকারী জজ’ পদবি বাতিল করে যথাক্রমে ‘সিভিল জজ’ এবং ‘সিনিয়র সিভিল জজ’ নামকরণ করা হয়েছে।

এর ফলে এখন থেকে দেওয়ানি আদালতের প্রাথমিক দুই স্তরের বিচারককে সিভিল জজ হিসেবেই পরিচিত করা হবে।

কেন এই পরিবর্তন জরুরি ছিল?

‘সহকারী’ শব্দটি আভিধানিকভাবে ‘সহায়ক’, ‘সহকারী কর্মচারী’ বা ‘শিক্ষানবিশ’ অর্থ বহন করে। ফলে পদবির সামনে ‘সহকারী’ শব্দটি থাকায় অনেকেই মনে করতেন তিনি আসলে কোনো মূল বিচারকের সহকারী। অথচ সংবিধানের ১১৬(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সহকারী জজ রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করেন।

১৮৮৭ সালের Civil Courts Act এ সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজের এখতিয়ার, কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। তাঁরা কারও সহকারী নন, বরং নিজেদের আদালতের স্বাধীন বিচারক।

এই বাস্তবতা ও মর্যাদা পদবিতে প্রতিফলিত না হওয়ায় বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, জেলা জজ এবং ইয়ং জাজেস ফোরাম বহুদিন ধরে পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছিল।

এছাড়া ২০০৭ সালের ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ প্রশাসন থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র অবস্থানে আসে। ফলে ‘সহকারী’ শব্দটি বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হয়।

ইতিহাস বলছে: ‘মুনসেফ’ থেকে ‘সহকারী জজ’, এখন সিভিল জজ

বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমলে দেওয়ানি আদালতের নিম্নস্তরের বিচারককে ‘মুনসেফ’ বলা হতো। ১৯৮৭ সালে অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে মিল রেখে এই পদবি পাল্টে ‘সহকারী জজ’ করা হয়। কিন্তু নতুন পদবিও দীর্ঘদিন একই সমস্যার উৎস হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এটি প্রকৃত বিচারিক ভূমিকা বোঝাতে ব্যর্থ ছিল।

একই সমস্যার আত্মপ্রকাশ ২০২৪-২৫ সালে আরও প্রকট হয়। বিচারক সমাজ এটিকে ‘মর্যাদাহানিকর’ ও ‘অযৌক্তিক’ বলে চিহ্নিত করে প্রস্তাব পাঠায়। অবশেষে ২০২৫ সালের অধ্যাদেশে সেই দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়িত হলো।

কারা হন সিভিল জজ (সাবেক সহকারী জজ)?

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে প্রবেশ করতে হয় কঠোর নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে, যা নেয় Judicial Service Commission (JSC)। এতে থাকে –

  • ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি

  • ১০০০ নম্বরের ১০টি লিখিত পরীক্ষা

  • ১০০ নম্বরের ভাইভা

এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাঁরা নিয়োগ পান, তাঁরা প্রথমে সিভিল জজ অথবা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁরা প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা এবং প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী কমিশনারদের সমপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা।

পদোন্নতির মাধ্যমে তাঁরা ক্রমান্বয়ে সিনিয়র সিভিল জজ, যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, জেলা ও দায়রা জজ এবং অনেকে পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিও হতে পারেন।

দেওয়ানি আদালতের কাঠামো

বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ে বর্তমানে পাঁচ ধরণের দেওয়ানি আদালত রয়েছে –

১. জেলা জজ (জেলা ও দায়রা জজ)
২. অতিরিক্ত জেলা জজ
৩. যুগ্ম জেলা জজ
৪. সিনিয়র সিভিল জজ
৫. সিভিল জজ

সিভিল জজরা মূলত জমি, চুক্তি, বিবাহ, দেনা পাওনা, মালিকানা সংশ্লিষ্ট দেওয়ানি মামলা বিচার করেন।

ফৌজদারি আদালত কেন আলাদা?

দেশের প্রতিটি জেলা এবং মহানগর এলাকায় দেওয়ানি আদালতের পাশাপাশি রয়েছে ফৌজদারি আদালত। এখানে বিচার করেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা। অপরাধের শাস্তির নিরিখে মামলাগুলো এই আদালতগুলোতে বিভাজিত হয়।
মহানগর এলাকায় সিটি করপোরেশনভুক্ত অঞ্চলকে আলাদা জেলার মর্যাদা দেওয়ার কারণে সেখানে রয়েছে মহানগর দায়রা আদালত এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এ ব্যবস্থা পুরোপুরি প্রশাসনিক ও বিচারিক কাজের সুবিধার্থে গড়ে ওঠা। অর্থাৎ সিটি করপোরেশন এলাকাকে মেট্রোপলিটন এলাকা ধরে আলাদা আদালত কাঠামো রাখা হয়েছে যাতে মামলা পরিচালনা সহজ হয়।

সংশোধিত আইন কী বলছে?

Civil Courts (Amendment) Ordinance, ২০২৫ অনুযায়ী ১৮৮৭ সালের Civil Courts Act–এর বেশ কয়েকটি ধারায় গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন আনা হয়েছে। পূর্বে যেখানে যেখানে Assistant শব্দটি ছিল, সেসব স্থানে এখন Civil শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

ফলে আইনের ভেতর থেকে Assistant Judge এবং Senior Assistant Judge নামে পদবির অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে উঠে গেছে।

যে ধারাগুলোতে সংশোধন হয়েছে: Section 3; Section 4; Section 13; Section 19; Section 21; Section 22; Section 23; Section 24; Section 25; Section 25A (নতুনভাবে প্রতিস্থাপিত)।

নতুন Section 25A বলছে, পুরনো পদবি (Additional Judge, Subordinate Judge, Senior Assistant Judge, Assistant Judge) এখন যথাক্রমে গণ্য হবে – Additional District Judge, Joint District Judge, Senior Civil Judge এবং Civil Judge হিসেবে।

এই পরিবর্তনের সুফল

  • বিচারকদের মর্যাদা সুরক্ষিত হবে

  • বিচারপ্রার্থীর ভুল বোঝাবুঝি কমবে

  • বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটবে

  • আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পদবি হবে

  • ভবিষ্যতে পুনরায় পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে না

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ভাষায়, ‘সহকারী’ শব্দটি বিভ্রান্তিকর ও মর্যাদাহানিকর, আর ‘সিভিল জজ’ নামটি বিচারকের প্রকৃত দায়িত্ব, ক্ষমতা ও পরিচয় যথার্থভাবে প্রকাশ করে

উপসংহার

নতুন এই সংশোধন শুধু একটি পদবি পরিবর্তন নয়, এটি একটি বিচারিক মর্যাদার পুনরুদ্ধার। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পেশাগত মর্যাদা ও বিচারপ্রার্থীর আস্থা বৃদ্ধির একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিক, বোধগম্য ও মর্যাদাসম্পন্ন করার পথে এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক মাইলফলক।

লেখক: লাইলাতুল ফেরদৌস, আইনি পরামর্শদাতা ও শিক্ষানবীশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট