বিচারের পথে আলোকবর্তিকা: প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ৭২ বছর

বিচারের পথে আলোকবর্তিকা: প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ৭২ বছর

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন ও প্রথম পূর্ণাঙ্গ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানটি গত ২৫ অক্টোবর ২০২৫, অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিভাগ বাংলাদেশের আইন শিক্ষা ও ন্যায়বিচার আন্দোলনের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ ৭২ বছরের গৌরবোজ্জ্বল যাত্রায় এই প্রথমবারের মতো প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে এমন এক মহামিলন অনুষ্ঠিত হয় যা ইতিহাসের নতুন অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তাঁর উপস্থিতি এবং প্রাঞ্জল বক্তব্য গোটা অনুষ্ঠানকে অনন্য মর্যাদা ও গভীর তাৎপর্য এনে দেয়। বক্তৃতায় তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের নৈতিকতা ও আইন শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে গভীর বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন, তা শিক্ষার্থী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং জাতির জন্যই এক আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আইন শুধুমাত্র নিয়ম বা বিধি নয়, এটি মানুষের মর্যাদা, ন্যায় এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিফলন। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের নৈতিক বিবেক, এবং এটি জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠিত। এটি ক্ষমতার হাতিয়ার নয়, বরং ন্যায়ের অভ্যন্তরীণ শক্তি, যা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।”

তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি সাংবিধানিক অঙ্গীকার, যা কার্যকর হলে জনগণ প্রকৃত ন্যায়বিচারের অভিজ্ঞতা লাভ করবে। তাঁর মতে, প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে বিচার বিভাগকে নৈতিকভাবে শক্তিশালী, দক্ষ এবং জনগণের আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

আরও পড়ুনবিচার বিভাগ কেবল ঐতিহ্যের স্বস্তিতে টিকে থাকতে পারে না : প্রধান বিচারপতি

বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, বিচারকদের বাজেট ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন, ই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়ন এবং ডিজিটাল কেস ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তনের মতো সংস্কারমূলক উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “এটি কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়; এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ২০২৪ সালের নৈতিক পুনর্জাগরণের প্রতিফলন।”

তাঁর ভাষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে তিনি বলেন, “২০২৫ সালের সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশকে ২৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভা যে ‘নীতিগত অনুমোদন’ দিয়েছে, তা একটি সুপরিকল্পিত ও বহুপাক্ষিক প্রয়াসের ফল। গত পনেরো মাসে এই প্রচেষ্টায় প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ের কৌশলগত ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে। এখন প্রয়োজন, সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজন—সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বার কাউন্সিল, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন— সবাই মিলেই এই কাঠামোগত রূপান্তরের টেকসই বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবেন। পারস্পরিক দায়বদ্ধতা, যুক্তিনিষ্ঠতা এবং প্রতিযোগিতামূলক অহংবোধ পরিহার—এই তিনটি নীতি হতে হবে বিচার বিভাগের স্থায়ী স্বাধীনতার মূলভিত্তি।”

প্রধান বিচারপতির ভাষণে উঠে আসে নৈতিকতা ও মানবিকতার গভীর বার্তা। তিনি বলেন, “আইন কেবল শাসনের হাতিয়ার নয়; এটি মানুষের মর্যাদা, সহমর্মিতা এবং ন্যায়বোধের প্রতিফলন। একজন বিচারকের কাজ শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ নয়; এটি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার দায়িত্ব বহন করে।”

আরও পড়ুনদুই আইনজীবীর বিরুদ্ধে অ্যাটর্নি জেনারেলের নাম ভাঙিয়ে ৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আইন শিক্ষার প্রকৃত মানে পেশাগত দক্ষতা অর্জন নয়, বরং এটি একটি নৈতিক অঙ্গীকার, একটি আস্থা এবং একটি সাংবিধানিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা।”

অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে দেশের বিচার ব্যবস্থার ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেন। তাঁরা বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের এই ৭২ বছরের যাত্রা শুধু শিক্ষা নয়, ন্যায় ও নৈতিকতার আলোকবর্তিকা হয়ে আছে।

এই প্রথম পুনর্মিলনীতে প্রধান বিচারপতির দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য সকলের মনে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। এটি প্রমাণ করেছে যে আইন শিক্ষা আদালতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার মধ্যেই এর পরিপূর্ণতা নিহিত।

প্রধান বিচারপতির উক্তি, “ন্যায় প্রতিষ্ঠা শুধু আদালতের দায়িত্ব নয়; এটি আমাদের সকলের নৈতিক অঙ্গীকার,” সেদিনের অনুষ্ঠানে প্রতিধ্বনিত হয়ে যায়।

২৫ অক্টোবরের এই ঐতিহাসিক দিনটি প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের যে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ক্রমে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, তার কেন্দ্রে রয়েছেন প্রধান বিচারপতির প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং নৈতিক নেতৃত্ব। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে আরও মানবিক, স্বচ্ছ এবং জনগণের ন্যায়প্রাপ্তির আদর্শে পরিণত করবে—এই আশাই ব্যক্ত করেছেন উপস্থিত শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বিচারপতি-আইনজীবী সমাজের প্রতিনিধিরা।