বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেটশীপ পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে তামাদি আইন অন্যতম। কম সময়ে সহজ ভাষায় তামাদি আইন আয়ত্ত্ব করার কৌশল নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট প্রিয়াঙ্কা মজুমদার। প্রথম পর্বে তামাদি অর্থসহ আইনটির প্রথম ২৮টি ধারার বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে আইনটির পরবর্তী ধারা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে।
ধারা-২৯: যে সকল ক্ষেত্রে তামাদি বিধান প্রযোজ্য নয়
১) এই আইনের কোন বিধান চুক্তি আইন ১৮৭২ এর ২৫ ধারাকে প্রভাবিত করবেনা। (৯ নং আইন)
২) তামাদির বিধান থাকলেও বিশেষ আইন প্রাধান্য পাবে।
৩) বিশেষ আইন দ্বারা প্রকাশ্যভাবে বাদ না দিলে এই আইনের ৪, ৯-১৮, এবং ২২ ধারা কার্যকর থাকবে।
৪) এই আইনের কোন বিধান ‘বিবাহ বিচ্ছেদ আইন১৯৬৯’ (৪ নং আইন) এর অধীনে কোন মামলায় প্রযোজ্য হবেনা।
৫) তামাদি আইনের ২৬ এবং ২৭ ধারা ও ২ধারায় বর্ণিত সুখাধিকারের সংজ্ঞা ১৮৮২ সালের সুখাধিকার আইনের এলাকা থেকে উদ্ভূত মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবেনা।
বিভিন্ন মামলা দায়েরে তামাদির সময়সীমা
২০১৭ সালের এডভোকেট তালিকাভুক্তির এমসিকিউতে ১০টি প্রশ্নের ৪টি এসেছিল ধারাভিত্তিক এবং ৩টি প্রশ্ন এসেছিলো তামাদি আইনের মেয়াদ ও অনুচ্ছেদ থেকে। তাই ধারা, সময়সীমা ও অনুচ্ছেদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৩টি অনুচ্ছেদসহ তামাদি সময় মনে রাখা সম্ভব নয়। আমরা শুধুমাত্র আবশ্যম্ভাবী অনুচ্ছেদগুলোই পড়বো। তামাদি সময় এবং অনুচ্ছেদ মনে রাখবেন যেভাবে,
যেসব মামলার তামাদি মেয়াদ ১ বছর সব একসাথে পড়ুন
১) অগ্রক্রয় অধিকার বলবতের মামলা
২) বিক্রয় রদের মামলা
৩) ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলা
৪) মানহানীর জন্য ক্ষতিপূরণ
৫) সুনির্দিষ্ট চুক্তি প্রবলের মামলা
৬) চুক্তি প্রত্যাহার/ রদের মামলা
৭) চুক্তিভঙ্গের ক্ষতিপূরণ ( ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চুক্তি লিখিত ও রেজিস্ট্রিকৃত না হলে ৩ বছর এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চুক্তি লিখিত ও রেজিস্ট্রিকৃত হলে ৬ বছর)
৩ বছর মেয়াদের মামলা
১) দলিল বাতিল বা রদ
২) অর্থ আদায়
৩) ভরণপোষণ/দেনমোহর
৪) প্রতারণামূলক ডিক্রি রদ
৫) দলিল জাল ঘোষণা
৬ বছরের মামলা
১) ঘোষণামূলক মোকদ্দমা (সুঃ প্রঃ আঃ ৪২ ধারা)
২) নিষেধাজ্ঞার মোকদ্দমা ( সুঃ প্রঃ আঃ ৫৪ ধারা)
এছাড়াও,
১) দখল পুনরুদ্ধারের তামাদি সময় ৬মাস।
২) স্বত্বসহ দখল পুনরুদ্ধারের তামাদি ১২বছর।
বিভিন্ন দরখাস্ত দায়েরের তামাদি সময় ক্রমানুসারে মনে রাখুন এভাবেঃ
১) মৃত্যুদন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল- ৭দিন।
২) জেলা জজ আদালতে আপীল- ৩০দিন।
৩) দায়রা আদালতে আপীল- ৩০ দিন।
৪) একতরফা ডিক্রি রদের আদেশ লাভের জন্য বিবাদীর দরখাস্ত- ৩০ দিন।
৫) হাইকোর্টে ফৌজদারী আপীল- ৬০ দিন।
৬) দন্ডবৃদ্ধির জন্য আপীল- ৬০দিন।
৭) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল- ৬০ দিন।
৮) হাইকোর্টে দেওয়ানী আপীল- ৯০ দিন।
৯) বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল- ৯০ দিন
১০) মৃত বাদী বা বিবাদীকে পক্ষভুক্ত করার সময়সীমা- ৯০ দিন।
১১) খালাস আদেশের বিরুদ্ধে আপীল- ৬ মাস।
জেনে রাখা ভাল
➡ডিক্রি জারীর জন্য প্রথম দরখাস্ত ১২বছরের মধ্যে দাখিল করতে হয়।
➡দেওয়ানী আদালতে ডিক্রি জারীর ক্ষেত্রে তামাদির মেয়াদ ১২ বছর।
➡ডিক্রি জারীর জন্য নতুন দরখাস্ত দাখিল করা যায় না ১২ বছর পর।
➡তামাদি আইনে রিভিশন দায়েরের মেয়াদ সংক্রান্ত বিধান নেই।
যে অনুচ্ছেদগুলো অবশ্যই অবশ্যই মনে রাখবেন এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ধারাগুলোও একইসাথে পড়ে রাখবেনঃ
১) ৩ অনুচ্ছেদঃ সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা মতে স্থাবর সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার ৬ মাসের মধ্যে।
২) ৯১ অনুচ্ছেদঃ সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৯ ধারা মতে দলিল বাতিলের মোকদ্দমা দায়ের মেয়াদ ৩ বছর।
৩) ১১৩ অনুচ্ছেদঃ সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১২ ধারা মতে সুনির্দিষ্ট চুক্তি প্রবল/ বলবৎ/ সম্পাদনের মামলা ১ বছর।
৪)১১৪ অনুচ্ছেদঃ চুক্তি প্রত্যাহারের মামলা ১ বছর।
৫) ১২০ অনুচ্ছেদঃ যে মামলায় তামাদির মেয়াদ সম্পর্কে কোন বিধান নাই ৬ বছর
৬) ১৪২ অনুচ্ছেদঃ সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারা মতে স্থাবর সম্পত্তি দখল পুনরুদ্ধারের মামলা ১২ বছর। (১৪৪ অনুচ্ছেদঃ জবর দখল ১২ বছর)
৭) ১৫০ অনুচ্ছেদঃ মৃত্যুদন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল ৭ দিন।
৮) ১৫৭ অনুচ্ছেদঃ খালাস আদেশের বিরুদ্ধে ফৌজদারী আপীল ৬ মাস।
৯) ১৬৩ অনুচ্ছেদঃ অনুপস্থিতির ফলে মামলা খারিজের আদেশ বাতিলের দরখাস্ত ৩০ দিন।
১০) ১৭৬ অনুচ্ছেদঃ মৃত বাদী বা বৈধ প্রতিনিধিকে পক্ষভুক্ত করার দরখাস্ত ৯০ দিন। (দেঃকাঃবিঃ ২২ আদেশ ৩ বিধি)
১১) ১৭৭ অনুচ্ছেদঃ মৃত বিবাদী বা বৈধ প্রতিনিধিকে পক্ষভুক্ত করার দরখাস্ত ৯০ দিন।(দেঃকাঃবিঃ ২২ আদেশ ৪ বিধি)
(বিঃদ্রঃ এই ১১টি অনুচ্ছেদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ)
সহজে মনে রাখার জন্য কিছু বিষয় একসাথে মিলিয়ে পড়ুন। যেমনঃ
➡ তামাদি আইনের ৫ ধারা প্রযোজ্য হবেনা স্যুটের ক্ষেত্রে
➡তামাদি আইনের ১৪ ধারা প্রযোজ্য হয় স্যুটের ক্ষেত্রে
➡ তামাদি আইনের কোন কিছুই প্রযোজ্য হবেনা চুক্তি আইনের ২৫ ধারার ক্ষেত্রে
➡ বৈধ অপারগতা ৬ ধারায়
➡ আইনগত অপারগতা ৬,৭,৮,৯ ধারায়
➡ ৯ ধারার ব্যতিক্রম ১২-১৬ ধারায়
➡ তামাদিমেয়াদগণনা১২- ২৫ধারায়
➡ তামাদি মেয়াদ গণনা আরম্ভ হয় ১২ ধারায়
কিছু ধারা অবশ্যই মনে রাখবেনঃ
➡৫ ধারাঃ বিলম্ব মওকুফ
➡ ৮ ধারাঃ বিশেষ ব্যতিক্রম
➡১৩ ধারাঃ বিবাদীর অনুপস্থিতকালীন সময় গণনা থেকে বাদ।
➡১৮ ধারাঃ প্রতারণা
➡ ২৩ ধারাঃ অবিরাম চুক্তিভঙ্গ
➡২৬ ধারাঃ সুখাধিকার অর্জন
➡২৮ ধারাঃ সম্পত্তির অধিকার বিলুপ্তি বা জবর দখল।
কিছু শব্দ সমার্থক এবং ইংরেজি অর্থসহ মনে রাখবেন
১) বিলম্ব মওকুফ (condonation of delay)
২) বৈধ অপারগতা/ অক্ষমতা (Legal disability)
৩) প্রতারণা (Fraud)
সবশেষে বলতে চাই, আইনের মত জটিল বিষয় আয়ত্তে আনতে একটা বিষয়কে বারবার পড়তে হবে। অনেকেই বলেন যে এত ধারা মনে রাখতে পারেন না। সব ধারা পড়ার দরকার নেই। যে ধারাগুলো বিগত এডভোকেটশীপ তালিকাভুক্তির এমসিকিউ (MCQ) এবং জুডিশিয়ারি পরীক্ষার এমসিকিউ (MCQ) তে এসেছে সে ধারা গুলোই পড়ুন। বাকি ধারাগুলো পড়তে পড়তেই মুখস্থ হয়ে যাবে। আমি ১ম পর্বে চেষ্টা করেছি তামাদি আইন সহজ ভাষায় ধারা ভিত্তিক আলোচনা করতে। আর আজকের আলোচনায় দেখিয়েছি কিভাবে দিন, বছর, অনুচ্ছেদক্রমানুসারে সাজিয়ে, একটার সাথে একটা মিলিয়ে পড়লে সহজে মনে রাখা যাবে তামাদি আইন। আশাকরি শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
লেখক : আইনজীবী, ফেনী জজ কোর্ট।