অ্যাডভোকেট জাহিদুল ইসলাম:
দীর্ঘ পড়ালেখার গন্ডি পাড়ি দিয়ে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন শেষে আইনজীবী হওয়ার বাসনায় তালিকাভুক্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে যারা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি জমা দিয়ে থাকেন তাদের পরিচয় শিক্ষানবিশ আইনজীবী। বর্তমানে এই শিক্ষানবিশ আইনজীবী শব্দদ্বয় অভিশপ্ত শব্দের সমার্থক শব্দে পরিনত হয়েছে আইন ডিগ্রিধারীদের নিকট।
এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে, যথাসময়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়া। নিয়মানুযায়ী তালিকাভুক্তির উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়ার পর ৬ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরে কোন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে তাতে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেন একজন শিক্ষানবিশ। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের একটি পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পরে আরেকটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে সময় লেগে যাচ্ছে দুই বছর কিংবা তার অধিক। আবার এই দীর্ঘ বিরতির পরে যদিও একটা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু সেই পরীক্ষার সকল ধাপ শেষ করে ফলাফল প্রকাশ করতে লেগে যায় আরও দেড় বছর বা তার অধিক। এই দীর্ঘ অযৌক্তিক সময়ক্ষেপণ এর যাতাকলে পিষ্ট হয়ে প্রতিটি শিক্ষানবীশ কে অযথা হয়রানি, সীমাহীন দুর্ভোগ ও এক প্রকার বেকারত্বের ঘানি টেনে চলতে হয়! নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের এমন ব্যর্থতা শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের যে হতাশায় নিমজ্জিত করে তা তাদের পেশাগত জীবনে সফলতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে তা সহজেই অনুমেয়। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বিনীত অনুরোধ ও দাবী থাকবে তারা যেন যৌক্তিক সময়ের মধ্যে আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হন এবং শিক্ষানবিশদের এমন দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
এতো গেলো যথাসময়ে পরীক্ষা না হওয়ার দুঃখের ইতিহাস। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের করুন গল্প এখানেই শেষ নয়। একজন শিক্ষানবিশ আইন ডিগ্রি অর্জন শেষে যে উদ্দেশ্যে নিয়ে একজন বিজ্ঞ সিনিয়রের চেম্বারে আগমন করেন তার সিকিভাগও পূরণ হয়না অধিকাংশের ক্ষেত্রে। অধিকাংশ বিজ্ঞ সিনিয়র মহোদয়ই শিক্ষানবিশদের ব্যবহারিক কাজ শেখাতে খুব একটা আগ্রহ দেখান না বা বাস্তবিক কারনে তা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা। শিক্ষানবিশদের প্রধানত যে কাজের জন্য উপযুক্ত বলে গণ্য করা হয় তা হলো এজলাস, জিআর ঘুরে মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ও অন্যান্য তথ্যাদি সংগ্রহ এবং দৌড়ঝাঁপ করে বিভিন্ন পিটিশন জমা দিয়ে আসা। এরূপ প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও যেসব শিক্ষানবিশ কাজ শেখার উদ্দেশ্য নিয়ে কোর্টে নিয়মিত আসেন তারা তাদের কাজের যে সম্মানি পেয়ে থাকেন তা উল্লেখ করলে শিক্ষানবিশদের দুঃখের আগুনে কেরোসিন ছিটানো হবে! বস্তুতপক্ষে আদালত অঙ্গনের বিরূপ পরিস্থিতির সাথে টিকতে না পেরে বহু শিক্ষানবিশ-ই আইনজীবী সনদ প্রাপ্তির পূর্বে আর কোর্টে যান না। ফলে আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও মামলা-মোকদ্দমা চালিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাদের তেমন সক্ষমতা থাকেনা যা আবার একটা নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করে অর্জন করে নিতে হয়। আমরা যদি মেডিকেল শিক্ষার্থীদের খেয়াল করি তাহলে দেখা যাবে যে তারা এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন শেষে একাডেমিক কোর্সের অংশ হিসেবেই ইন্টার্নশিপ করেন এবং সেখানে তারা অত্যন্ত সুচারুরূপে চিকিৎসা বিদ্যায় তাদের অর্জিত জ্ঞানকে প্রায়োগিক দক্ষতায় রুপান্তরের সুযোগ পেয়ে থাকেন। আমাদের শিক্ষানবিশদের শিক্ষানবিশ সময়টাও যদি একাডেমিক কোর্সের অংশ করে দেয়া হয় তবে আইন শিক্ষার্থীরা তাদের অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগের কৌশল শিখবেন সহজেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই ৪ থেকে ৬ মাসের ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালু করার বিধান করা উচিত বাধ্যতামূলকভাবে।
ইদানিংকালে দেখা যাচ্ছে যে অনেক জেলা বার এসোশিয়েশনগুলোই শিক্ষানবিশদের ওপর অনেক অযৌক্তিক বিধি-নিষেধ আরোপ করে যাচ্ছেন। যার প্রধান উদ্দেশ্য শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের আদালত প্রাঙ্গন থেকে বিতাড়িত করা। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের প্রতি নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞ সিনিয়রগণের এমন অসহনশীল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়াটা কাম্য নয়! আমি ঢাকা জজ কোর্টের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যদি সকল শিক্ষানবিশ ছেলেমেয়েরা একযোগে সিনিয়রের চেম্বারে যাওয়া বন্ধ করে তবে বহু বিজ্ঞ সিনিয়রদের চেম্বারের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পরবে। সারাদিন অমানুষিক খাটুনি খেটে এই শিক্ষানবিশরাই চেম্বার সচল রাখে। তার বিনিময়ে অনেকক্ষেত্রে একটু ভাল আচরণ ও উৎসাহ প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত হন তারা। একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর প্রধান কাজই হলো নিয়মিত বিজ্ঞ সিনিয়রের সান্নিধ্যে থেকে কোর্টের ব্যবহারিক কাজ শেখা এবং সে যদি আইন বহির্ভূত কিছু না করে তবে তার ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাটা মোটেই কাম্য নয়। আজকের শিক্ষানবিশ আগামী দিনের বিজ্ঞ আইনজীবী। তাই তাদেরকে বিকশিত হবার সুযোগ না দিয়ে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার রীতি বন্ধ হওয়া উচিত।
শিক্ষানবিশ আইনজীবীদেরকে আইন পেশায় টিকিয়ে রাখতে ও তাদেরকে বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে যথাসময়ে বার কাউন্সিল পরীক্ষা গ্রহণ ও সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই প্রত্যাশা করি।
লেখক : আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।