পাঁচ বছর আগে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় ঢাকার এক দম্পতির। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় কন্যাসন্তানের জন্ম। সেই সন্তান নিয়ে সুখেই কাটছিল দিন। তবে এরপর স্ত্রীর আচরণে অসন্তুষ্ট স্বামী। দুজনের মধ্যে শুরু হয় মান-অভিমান। তাঁদের টানাপোড়েন শেষ হয় বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্ত্রীকে তালাক দেন স্বামী।
এরপরই বাচ্চা নিয়ে শুরু হয় তাঁদের মধ্যে আইনি লড়াই। কন্যাশিশুর অভিভাবক হওয়ার জন্য স্ত্রীকে বিবাদী করে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন স্বামী। আদালতের আদেশে কন্যাশিশু বাবার কাছেই বড় হতে থাকে। তবে ১৫ দিন পরপর মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন মা। কিন্তু এই সামান্য সময়ের দেখায় মায়ের মন আর ভরে না। মেয়ের জন্য তাঁর মন কাঁদত। মা-বাবার এই কষ্টের জীবন শিশুটির মনে প্রভাব ফেলে। মেয়ের কথা ভেবে মনোজগতে পরিবর্তন আসে তাঁদের। মেয়ের জন্য সব মান-অভিমান ভুলে যান তাঁরা। সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা আবার বিয়ে করবেন। যেমন কথা, তেমন কাজ। দুজনে আপস করে লিখিতভাবে আদালতকে তা জানান। ঢাকার আদালতের সম্মতিতেই রোববার (১৪ জুলাই) আদালতের এজলাসে তাঁদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিয়ের পর আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে এই দম্পতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিচ্ছেদ বড় কষ্টের, বিচ্ছেদ বড় যন্ত্রণার। আমরা বিচ্ছেদ চাই না। নিষ্পাপ সন্তানের সুখের আশায় আমরা আবার এক হয়েছি। আমরা সারা জীবন এভাবেই থাকতে চাই। আমরা সকলের দোয়া চাই।’
তখন বেলা দুইটা। লালসালুঘেরা এজলাসে বিচারক বসে ছিলেন। তাঁর সামনে তিন থেকে চারখানা বেঞ্চ। সেখানে বসে আছেন আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা। বেঞ্চের দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বর আর কনে। সঙ্গে তাঁদের অভিভাবক।
আদালতের সামনে সারির বেঞ্চে বসা ছিলেন কাজি মো. শামসুল হুদা। কাবিননামায় বর-কনের নাম-ঠিকানা লিখে চলেন তিনি। পাশে ছিলেন বর-কনের দুই আইনজীবী। কাবিননামায় কাজির লেখা শেষ।
কাজি শামসুল হুদা তখন বরকে কাছে ডেকে নিলেন। বসালেন পাশে। কাবিননামায় স্বাক্ষর নিলেন। বরের কাজ শেষ হলে কনেকে ডাক দেন কাজি। কনে এসে বসলেন কাজির পাশেই। নিলেন তাঁরও স্বাক্ষর। তারপর কনের বাবাকে ডাকা হলো। বরের হাতে নিজের কন্যাকে সমর্পণ করলেন বাবা।
সবার সামনে বর-কনে কবুল বললেন। আদালতের সামনে বর-কনের বিয়ে হলো। দোয়া শেষ হলে আদালতের এজলাসে উপস্থিত সবাইকে মিষ্টি খাওয়ান বর-কনে।
বর-কনের বিয়ের পর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ জহিরুল আলম এজলাস ত্যাগ করেন। ভরা এজলাসে বর-কনের মুখে তখন হাসি।
বর বলেন, ‘বিয়ের পর আমরা ভালোই ছিলাম। বাচ্চা হলো। কত সুখেই কাটছিল আমাদের দিন। কিন্তু ভুল-বোঝাবুঝির কারণে আমাদের বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু আদরের কন্যা আবার আমাদের এক করে দিল। বাচ্চার সুখের কথা ভেবেই মান-অভিমান ভুলে আমরা এক হয়েছি। আজ আমাদের সুখের দিন।’
স্বামীর কথা শুনে স্ত্রীও আবেগতাড়িত।
স্ত্রী বললেন, ‘প্রায় দেড় বছর হলো আমরা একত্রে থাকি না। আমার মেয়ে ওর বাবার কাছে থাকে। ওকে দেখার জন্য আমার মন কত যে ছটফট করত, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমরা এক হয়েছি। আজীবন এভাবেই থাকতে চাই।’
বহুজাতিক একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন বর। কনেও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
বিয়ের পর ওই নারী স্বামীর সঙ্গে ছিলেন। স্বামীর একান্নবর্তী পরিবার। আছে শ্বশুর-শাশুড়ি। আদালতের কাছে স্বামী দাবি করেন, তাঁর স্ত্রী উচ্চাভিলাষী। স্বামী-সংসারের প্রতি উদাসীন। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন। অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতেন। ফেসবুকে নানাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।
তবে ওই নারী এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
ওই নারীর আইনজীবী ফরিদ আহমেদ বলেন, স্বামী স্ত্রীকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। সেই সন্দেহ থেকে তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। তবে বাচ্চার জন্য আবার তাঁরা একত্র হয়েছেন। একসঙ্গে সংসার করার প্রতিজ্ঞা করেছেন।
একই কথা বলেন বরের আইনজীবী মলয় সাহা। তিনি বলেন, ‘আমরা চারদিকে কেবল বিচ্ছেদের গল্প শুনতে পাই। এই যুবক-যুবতী মান-অভিমান ভুলে আবার এক হয়েছেন। আমরা তাঁদের অভিনন্দন জানাই।’ প্রথম আলো