বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থানার বাসিন্দা হারুন অর রশিদ। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই। চট্টগ্রামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়। মোরেলগঞ্জ থানা–পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে গত ৪ জুলাই আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। পরে তাঁর স্বজনেরা জানতে পারেন, তাঁকে যে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই নম্বরে চট্টগ্রামে কোনো মামলা নেই। এমনি পরোয়ানায় লেখা আছে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম–১৪। অথচ এখানে হাকিম আদালত আছে ছয়টি। এরপর তাঁর আইনজীবী আদালতে জামিনের আবেদন করেন। আদালত পরোয়ানায় থাকা মামলা নম্বরের খোঁজ নিয়ে কোনো অস্তিত্ব পাননি। গত সোমবার হারুনকে মুক্তির আদেশ দেন বিচারক।
হারুন অর রশিদ বলেন, জীবন থেকে ২৫টি দিন হারিয়ে গেল। যারা এই কাজে জড়িত তাদের যেন শাস্তি হয়। তাঁকে আইনি সহায়তা দেন চট্টগ্রামের আইনজীবী রফিকুল আলম। তিনি বলেন, এক আত্মীয়ের অনুরোধে মানবিক কারণে হারুণকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন।
শুধু হারুন নন, অনিল ও হানিফ নামে দুজন বিনা দোষে ভুয়া পরোয়ানায় কারাবাস করেছেন। আদালতে গিয়ে জামিন নিয়েছেন নাছির, জসিম, আমিরসহ অনেকে। গত দুই মাসে চট্টগ্রাম আদালতে ভুয়া পরোয়ানার নয়টি ঘটনা ধরা পড়ে।
চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ ওসমান গণি গত রোববার ভুয়া পরোয়ানা তৈরিকারী চক্রকে শনাক্তের জন্য নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
বিচারক আদেশে উল্লেখ করেন, কোনো মামলা না থাকলেও ভুয়া পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আদালতের সিলমোহর জাল করে একটি চক্র এটি করেছে। এতে নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে।
চট্টগ্রাম আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবিদ হোসেন বলেন, ভুয়া পরোয়ানাগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো ভুয়া। বিচারকের সই ও মোহর রয়েছে। স্মারক নম্বর আছে। অর্থাৎ একটি পরোয়ানায় যা যা থাকে সবই রয়েছে ভুয়া পরোয়ানায়। পূর্বশত্রুতা কিংবা জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে একটি চক্রের মাধ্যমে কাজটি
আদালত সূত্র জানায়, যেকোনো মামলায় বিচারক আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিতে পারেন। এরপর সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী আদালতের নির্ধারিত পরোয়ানা ফরমে আসামির নাম-ঠিকানা ও মামলা নম্বর লিখে স্মারক নম্বর দিয়ে থাকেন। এরপর এটি আদালতে দায়িত্বরত প্রসিকিউশনের (পুলিশ) কাছে পাঠান। সেখানে আরেকটি স্মারক নম্বর পড়ার পর সংশ্লিষ্ট ঠিকানার আওতাধীন পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের মাধ্যমে থানায় যায়। থানা-পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে থাকেন।
এতগুলো ঘাট পেরোনোর পর কীভাবে ভুয়া পরোয়ানাগুলো থানা-পুলিশের কাছে যায় প্রশ্ন করা হলে নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) কাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, যেসব ভুয়া পরোয়ানায় লোকজন হয়রানির শিকার হয়েছেন এগুলোতে থাকা স্মারক নম্বরও ভুয়া। জালিয়াত চক্র আদালতের জাল সিলমোহর ব্যবহার করে থানা-পুলিশের কাছে ডাকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। চক্রটিকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
আদালতে দায়িত্বরত পুলিশ কিংবা কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ছাড়া চক্রটি কীভাবে আদালতের সিলমোহর ব্যবহার করে থাকে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জড়িত কারা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
কয়েকটি ঘটনা
কক্সবাজারের পেকুয়ার একটি স্কুলের অফিস সহকারী অনিল কান্তি সুশীল। চট্টগ্রামের ইপিজেড থানার একটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালত থেকে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যায় গত ২৪ জুলাই ইস্যু করা। এর আগে কক্সবাজারের সদর থানার মামলার একটি ভুয়া পরোয়ানায় তিনি কারাবাস করেছিলেন। বিষয়টি উল্লেখ করে আদালতে তিনি হাজির হন ২৫ জুলাই। পরে আদালত তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন। ওই নম্বরের কোনো মামলার অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি।
নোয়াখালীর হাতিয়ার বাসিন্দা মো. হানিফ। অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় মামলা নেই। এরপরও পুলিশ ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় হানিফকে ৩০ জুন গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়। এরপর জানা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে হাতিয়া থানা-পুলিশের কাছে যাওয়া পরোয়ানাটি ভুয়া। পরোয়ানায় যে আদালতের নাম দেওয়া হয়েছে ওই নামে কোনো আদালত নেই। বিনা অপরাধে চার দিন কারাভোগের পর ৪ জুলাই জামিনে মুক্তি পান তিনি।
ভুয়া পরোয়ানায় জালিয়াত চক্রটিকে শনাক্ত করার দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আইয়ুব খান। তিনি বলেন, চক্রটিকে আইনের আওতায় না আনলে মানুষের হয়রানি বাড়তে থাকবে।