দোকানে একটি শিঙাড়ার দাম সাধারণত পাঁচ থেকে দশ টাকা। কিন্তু চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ক্যানটিনে বন্দীরা একটি শিঙাড়া খান ৬০ টাকায়। বিভিন্ন পণ্য, চিকিৎসা ও ঘুমানোর জায়গা পেতে ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হয় বন্দীদের। টাকায় মেলে ‘বিশেষ’ সাক্ষাৎও। বন্দী ও স্বজনদের ভাষ্য, কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টাকা তৈরির যন্ত্রে পরিণত হয়েছে এটি। কারাগারের দেয়ালও যেন টাকা খায়।
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারা ক্যানটিনে বন্দীরা একটি পেঁয়াজ ২০ টাকা, সিগারেট ৬০ টাকায় কেনেন। ছয় গুণ বাড়তি দাম হওয়ায় ক্যানটিন থেকে ‘আয়’৭ লাখ টাকা। ‘সাক্ষাৎ বাণিজ্য’ থেকে আসে সাড়ে ২২ লাখ টাকা। একজন বন্দীর স্বজনকে ‘অফিস সাক্ষাতের’ জন্য দিতে হয় দেড় হাজার টাকা। এ রকম সাক্ষাৎ দৈনিক অর্ধশতের বেশি। কারা হাসপাতালে নিচে ঘুমালে ৬ হাজার, ওপরে ঘুমালে ১২ হাজার টাকা করে দিতে হয়। ‘বিশেষ’ ওয়ার্ডে থাকতে মাসে একজনের লাগে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। বন্দীর কাছ থেকে এসব খাতে মাসে আসে ২০ লাখ। তিনটি খাতে মাসে কারা কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ‘আয়’ ৪৯ লাখ টাকা। তবে এটি বাড়ে–কমে।
১ হাজার ৮৫৩ বন্দীর ধারণক্ষমতার এই কারাগারে বন্দী থাকেন গড়ে ৯ হাজার। গত মার্চে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত এই কারাগারের ৪৯ জনকে চিহ্নিত করা হয়। মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে দুদক এদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। দুদক গত মাসে এর ৩৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে করেছে।
টাকায় মেলে ‘বিশেষ’ সাক্ষাৎ
নগরের কুলগাঁও থেকে সালাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি ভাইয়ের জামিনের বিষয়ে দেখা করতে যান। কিন্তু অফিস কক্ষে সাক্ষাতের জন্য দেড় হাজার টাকা দিতে না পারায় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। হতাশা প্রকাশ করে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কারাগারের দেয়ালও টেআ খায়।’
সালাউদ্দিনের কথার সঙ্গে মিলে যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির গত মার্চ মাসে দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্য। সেখানে সাক্ষাৎ বাণিজ্যের কথা উঠে আসে। কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস গত বছরের ২৬ অক্টোবর ৪৪ লাখ টাকা ও কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) পার্থ গোপাল বণিক ওই ঘটনার নয় মাসের মাথায় ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার হন। টাকার উৎস খুঁজতে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ২৮ জুলাই ডিআইজি প্রিজনসকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক ও জেল সুপার সোহেল রানা বিশ্বাস। বর্তমানে বরিশালের জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিককে ৪ আগস্ট দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, কারাগারের সাক্ষাৎ কক্ষের লোহার জালি বেশ ঘন। এ কারণে কেউ কারও মুখ দেখতে পান না। কথাও শোনা যায় না। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কারাগারের অফিস কক্ষে বিশেষ ব্যবস্থায় মিলছে সাক্ষাতের সুযোগ।
মো. আসলাম নামের এক ব্যক্তিকে ১০ জুন দুপুরে কারাগারের মূল ফটকের সামনে বসে থাকতে দেখা যায়। তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন এক বন্দীর কয়েক স্বজন। এরই মধ্যে এক নারী কারাগারের অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর দুই হাজার টাকা গুঁজে দেন আসলামের হাতে। একপর্যায়ে এই প্রতিবেদক অফিস কক্ষে এক বন্দীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বললে আসলাম তিন হাজার টাকা দাবি করেন। কার মাধ্যমে সাক্ষাৎ করা হবে জানতে চাইলে আসলাম বলেন, ভেতরে এক অফিসার আছেন। বলে দিলে হবে। ১৯ জুন দুপুরেও আসলামকে সাক্ষাৎ কক্ষের সামনে টাকা নিতে দেখা যায়। অফিস কক্ষে সাক্ষাতের ব্যবস্থা একসময় থাকলেও এখন পুরোপুরি বন্ধ বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. কামাল হোসেন।
মেলে না ঘুমানোর জায়গাও
নতুন কোনো আসামি কারাগারে যাওয়ার পর প্রথমে ‘আমদানি ওয়ার্ডে’ রাখা হয়। পরদিন সকালে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয় বন্দীদের। সেখানে চলে টাকার খেলা। আমদানি ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করেন কয়েদি মো. পারভেজ, মো. নজরুল, মো. ইউনুস, মো. মতিন, মো. শহিদ, মো. জহির ও দেলোয়ার। এদের পাঁচ শ থেকে তিন হাজার টাকা দিলেই বন্দীরা ওয়ার্ডে শোবার জায়গা পান। ইয়াবা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এক রিকশাচালক কারাগারে আছেন। হাজিরা দিতে এসে চট্টগ্রাম আদালতের হাজতখানায় পুলিশের উপস্থিতিতে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, টাকা দিতে না পারায় কর্ণফুলী ওয়ার্ডে শৌচাগারের পাশে ছিলেন। তাঁর মতো গরিব বন্দীদের একই অবস্থা।
ডাল যেন পানি, মাংস বলতে হাড়
বন্দীদের ভাষ্য, এখানকার ডাল যেন পানি। সবজি থাকে পচাগলা। মাংসের টুকরো বলতে কেবল হাড়। আর মাছ বলতে ছোট্ট একটি টুকরো। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া মো. রিপন নামের এক বন্দী বলেন, এই খাবার খেতে না পারায় বেশির ভাগ বন্দী বাধ্য হয়ে বেশি দামে ক্যানটিন থেকে কিনে খান। একটি টুকরো মুরগির মাংসের দাম রাখা হয় ৮০ টাকা, যা বাইরে বড়জোর ৪০ টাকা। বর্তমান জেলার নাশির আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার পর কম দামে বিক্রি হচ্ছে। সোহেল রানা থাকাকালে দাম আরও বেশি নেওয়া হতো।
জেল সুপার মো. কামাল হোসেন বলেন, ক্যানটিনে বাড়তি দাম নেওয়ার সুযোগ নেই । এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে কী হয়েছে তিনি জানেন না।
ঠাঁই হয় না হাসপাতালেও
টাকা দিলে চিকিৎসা মেলে। না হলে ঠাঁই হয় না কারা হাসপাতালে। এক মাস আগে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ১০ জন আসামির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের অভিযোগ, সুস্থ হলেও রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিত্তবান বন্দীরাই কারা হাসপাতালে থাকার সুযোগ পান। আর অসুস্থ হয়েও গরিব বন্দীদের সেখানে ঠাঁই হয় না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কারাগার পরিদর্শনে আসার আগে রোগী সেজে থাকা বন্দীদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জন মোস্তাফিজুর রহমান ও ফার্মাসিস্ট রুহুল আমিনসহ কারাগারের ৪৯ কর্মকর্তার অনিয়মের তথ্য পান। গত মাসের শেষের দিকে কারাগার পরিদর্শন শেষে দুদক পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, কারা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন খাতে মাসে অবৈধ আয় ৪০ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বপরায়ণ কর্মকর্তাদের নিয়োগে প্রাধান্য না দিলে কারাগারে টাকার খেলা বন্ধ হবে না। সূত্র- প্রথম আলো