রাজীব কুমার দেব:
“Doctrine of Superiority Impact”একটি জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল ধারণা যার স্বীকৃতি বিশেষ আইনে লক্ষ্যণীয়৷বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ অবস্থায় বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ অপরাধের বিচারের নিমিত্তে সাধারণ আইনের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থা এড়ানোর জন্যই মূলত বিশেষ আইনে এই ধারণা সন্নিবেশ করা হয়ে থাকে। অপরদিকে উচ্চাদালতের নজীর অধঃস্তন আদালতের উপর বাধ্য কর – একটি সাংবিধানিক রীতি।
তবে “Doctrine of Superiority Impact” কিছু মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন – প্রথমত, সংশ্লিষ্ট আইনটি অবশ্যই একটি বিশেষ আইন হবে এবং সর্বশেষ আইনটি পূর্বের আইনসহ সকল সাধারণ আইনের উপর প্রাধান্য পাবে। দ্বিতীয়ত, বিশেষ আইন সাধারণ আইনের উপর প্রাধান্য পাবে এবং তৃতীয়ত, নতুন আইনে ভিন্নতর কিছু থাকতে পারবে না।
“Doctrine of Superiority Impact” ২০১৩ সনের শিশু আইনে একটি লক্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিধান। তবে এই আইন একটি ব্যতিক্রম ধর্মী আইন।এটি purely পদ্ধতিগত আইনও নয় আবার পুরোপুরি Remedial নয়। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের বিধানাবলী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিশু অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বিশেষ ব্যবস্থায় বিশেষ আদালতের মাধ্যমে পরিচালনা করতেই এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
শিশু আইনের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হল আমল যোগ্যতা। সাধারণত বিশেষ আইনে সৃজিত ট্রাইব্যুনাল বা ক্ষেত্রমতে আদালতকে একইসাথে আমল ও বিচারের ক্ষমতা দেওয়া হয় কিন্তু শিশু আইনে সৃজিত “শিশু আদালত” কে বিচারের ক্ষমতা দেওয়া হলেও আমলের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি আবার আমলের ক্ষমতা কাকে দেওয়া হয়েছে তা নিয়েও ধোয়াশা ছিল। উপরন্তু ২০১৮ সনের ২ (১৬ক), ১৫ (ক) (ক) সংশোধনী আকারে সংযোজন বিভিন্ন ধরনের সংশয়, বিভ্রান্তি ও সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে বলে সাধারণের ধারণা।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অতি সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনের মহামান্য বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান এর একটি বেঞ্চ ফৌজদারী আপীল নং৭৫৩৩/২০১৯ এ ১৪পৃষ্টার একটি রায়ে শিশু আইনের কতেক মৌলিক বিষয়ে স্পষ্টীকরণসহ আমলযোগ্যতা নিয়ে অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছেন। আবেদনের পক্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোঃ মশিউর রহমান।
শিশু আইনের অধীনে আমলযোগ্যতা পর্যালোচনায় তিনটি প্রশ্ন সামনে আসে–
এক. শিশু আইনে কে বা কোন বিচারক অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন? দুই. শিশু আইনে আমল গ্রহণকারী বিচারক কি বিশেষ আইনের অপরাধসমূহ, যেমন- বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪, দুর্নীতি দমন আইন, ২০০৪, মানব পাচার আইন, ২০১২, মানিলন্ডারিং আইন, ২০১২, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ ইত্যাদি আইনের অপরাধসমূহের আমল গ্রহণ করতে পারবেন? এবং তিন. যদি তাই হয়, তাহলে কি সাংবিধানিক তথা আইনের ব্যত্যয় হবে?
শিশু আইনের ধারা ২(১৬ক), ধারা ১৫ ও ধারা ১৫(ক) একইসাথে পর্যালোচনা করলে প্রথম প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।কেননা এই তিনটি বিধানের মর্মার্থ এই যে, একজন স্বীয় এখতিয়ার সম্পন্ন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শিশু অপরাধের পুলিশ প্রতিবেদন (দোষিপত্র) গ্রহণ করে বিচারের জন্য নথি প্রস্তুত করবেন এবং উক্ত আইনের ধারা ১৬(১) মতে গঠিত সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে প্রস্তুতকৃত নথি প্রেরণ করবেন।অর্থাৎ শিশু আইন একমাত্র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকেই অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে অন্যকোন বিচারককে নয় এমন কি সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতকেও নয়। সুতরাং এটি একটি সেটল্ড ইস্যু যে, একমাত্র স্বীয় এখতিয়ার সম্পন্ন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শিশু আইনে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন এবং তিনিই একমাত্র আমল গ্রহণকারী বিচারক।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে শিশু আইনের ধারা ৩, ধারা ১৫(২) ও ধারা ১৫ (ক) (ক) তে এবং মহামান্য উচ্চাদালতের সিদ্ধান্তে। সাথে সহযোগি হিসেবে থাকবে জুরিস্প্রুডেন্সিয়াল ও সাংবিধানিক ব্যাখ্যার আদলে প্রতিষ্ঠিত “Doctrine of Superiority Impact”।
শিশু আইনের ধারা ৩ মতে আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাবে।অর্থাৎ “Doctrine of Superiority Principle” অনুসারে বর্তমান সময় পর্যন্ত বলবতযোগ্য সকল আইনের উপর শিশু আইন প্রাধান্য পাবে যদি না নতুন কোন আইনে ভিন্নতর কিছু থাকে। শিশু আইনের ধারা ১৫ (১, ২) মতে আমল গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেট শিশু অপরাধের পৃথকভাবে দাখিলকৃত পুলিশ প্রতিবেদন পৃথকভাবেই (Split Up) অপরাধ আমলে গ্রহণ করে একই আইনের ধারা ১৫ (ক) (ক) মতে নথি বিচারের জন্য প্রস্তুত করে শিশু আদালতে প্রেরণ করবেন।
তবে বিশেষ আইনের মামলাটি যদি নালিশী মামলা হয় এবং সেইক্ষেত্রে অভিযুক্ত যদি শিশু হয় তাহলে কে আমল গ্রহণ করবেন এবং কি পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে এই প্রশ্নে শিশু আইন নিরব।এই নিরবতা ভেঙে এই প্রশ্নের উত্তরে মহামান্য উচ্চাদালত রায়ের সাতটি নির্দেশনার মধ্যে ষষ্ঠ নির্দেশনায় বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। ষষ্ঠ নির্দেশনায় মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন যে, বিশেষ আইনের সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল বা ক্ষেত্রমতে, আদালত, নালিশী মামলা গ্রহণ করে যথাযথ আইনি কার্যক্রম গ্রহণ করে আমল গ্রহণের জন্য স্বীয় এখতিয়ারাধীন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পাঠাবেন এবং ম্যাজিস্ট্রেট আমল গ্রহণ করে বিচারের জন্য প্রস্তুত করে নথি শিশু আদালতে প্রেরণ করবেন।
আবার উক্ত রায়ের ৭ম নির্দেশনা অনুসারে বিশেষ আইনের জিআর মামলায় স্বীয় এখতিয়ার সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে পাঠাবেন।
তবে ধারা ১৫(১, ২), ধারা ১৫(ক) (ক) এবং মহামান্য উচ্চাদালতের উক্ত রায়ের ষষ্ঠ ও ৭ম নির্দেশনা অনুসারে, সিআর বা জিআর উভয় মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক অভিযুক্তের পৃথক প্রতিবেদনসহ নথি Split Up করে সংশ্লিষ্ট এখতিয়ারাধীন ট্রাইব্যুনাল বা ক্ষেত্রমতে আদালতে পাঠিয়ে দিবেন।
সুতরাং সার্বিক বিশ্লেষণে এটি মীমাংসিত বিষয় যে, শিশু আইনে আমল গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেট বিশেষ আইনের অপরাধসমূহ (সিআর বা জিআর, উভয়ক্ষেত্রেই) যেমন- বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪, দুর্নীতি দমন আইন, ২০০৪, মানব পাচার আইন, ২০১২, মানিলন্ডারিং আইন, ২০১২, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ ইত্যাদি আইনের অপরাধসমূহের আমল গ্রহণ করতে পারবেন এবং একইভাবে করবেন।
তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর মহামান্য উচ্চাদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে পাওয়া যায়। উক্তপর্যবেক্ষণে মহামান্য উচ্চাদালত অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন – “আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, শিশু আইনের ধারা ১৫(ক) এর বিধান বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭২ এর ধারা ২৭, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ২৭, এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ধারা ৪৮ সহ বিভিন্ন বিশেষ আইনের সাথে শুধু অসংগতিপূর্নই নয়, সাংঘর্ষিকও বটে।”
মহামান্য উচ্চাদালত আরো মত প্রকাশ করেন যে, “শুধু তাই নয়, একই আইনের অধীনে শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন ম্যাজিস্ট্রেট, আর প্রাপ্তবয়স্কদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল বা ক্ষেত্রমতে, আদালত, যা বাস্তবতা বিবর্জিত (Impractical) এবং অদ্ভূত বা অস্বাভাবিক (Peculiar) একটি প্রস্তাবনা।”
বিশেষ আইনের নালিশী দরখাস্তের মামলায় ট্রাইব্যুনাল বা আদালত আমল গ্রহণের নিমিত্তে নথি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করবে এই প্রস্তাবনায় মহামান্য হাইকোর্ট অভিমত প্রকাশ করেছেন- “যদি তাই হয় তাহলে আবারো বলতে দ্বিধা নেই যে, এটাও একটি অবাস্তব এবং অদ্ভূত প্রস্তাবনা (Proposition)।”
এ বিষয়গুলোর উত্তরে মহামান্য উচ্চাদালত শিশু আইনে ম্যাজিস্ট্রেট শব্দের পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল ক্ষেত্রমতে আদালতশব্দাবলী যোগ করা অত্যন্ত জরুরী ও বাস্তব সম্মত বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে আইন সংশোধন ছাড়া এ জটিল ও অবাস্তব প্রক্রিয়া বা কার্যপ্রণালী এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়।
মহামান্য উচ্চাদালত সুচিন্তিত পর্যবেক্ষণ ও অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন যে, “শিশু আইনে সাংঘর্ষিক অবস্থা, বিদ্যমান অসংগতি, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন, এবং আদালত এটাও প্রত্যাশা করছে যে, এ লক্ষ্যে সরকার দ্রুততার সাথে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সরকার শিশু আইন সংশোধন অথবা শিশু আইন, ২০১৩ এর ৯৭ ধারা বিধানমূলে গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা অস্পষ্টতা ও অসংগতিদূর করতে পারে। সরকার কর্তৃক আইনের যথাযথ সংশোধন বা স্পষ্টকরণ সম্পর্কে প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত শিশুর সর্ব্বোচ্চ স্বার্থ পদ্ধতি/প্রনালী (Procedure) অনুসরণে নির্দেশনা প্রদান করা যাচ্ছে।”
এরুপ আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত মহামান্য উচ্চাদালত রায়ে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসারে আমল গ্রহণ, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছেন।
পরিশেষে শিশু আইন প্রণয়নের সময়কাল থেকে এর প্রয়োগ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নিয়ে জড়িলতা ও বিভ্রান্তি ছিল।কিন্তু বরাবরের মতই আমাদের উচ্চাদালত তার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সুষ্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করে বিভ্রান্তি ও জটিলতা দূর করতে সক্ষম হয়েছেন।তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মহামান্য উচ্চাদালতের রায়ে উল্লিখিত প্রস্তাবনা ও নির্দেশনা সংশোধনী আকারে সংযোজন হলে শিশু আইনের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবে এবং সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের শিশু সনদ বাস্তবায়নে প্রত্যেক্ষ ভূমিকা রাখায় অগ্রগামী হবে।
লেখক: জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট; চকরিয়া চৌকি আদালত, কক্সবাজার।