রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ৮৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্দী বেচাকেনা, সুস্থ বন্দীদের টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে ভর্তি, সাক্ষাৎ ও জামিন–বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম। অভিযুক্তদের মধ্যে এই কারাগারের বড় কর্মকর্তারাও রয়েছেন।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামান বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) সৈয়দ বেলাল হোসেনকে প্রধান করে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটি তদন্ত শেষে সম্প্রতি ৪৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজশাহী কারা প্রশাসনের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আলতাফ হোসেন, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার হালিমা খাতুন, জেলার হাবিবুর রহমান, ডেপুটি জেলার সাইফুল ইসলামসহ ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। ডিআইজির বিষয়ে প্রতিবেদন বলছে, তিনি এসব অনিয়মের বিষয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। উল্টো দায়িত্বে অবহেলা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ডিআইজির বাসায় আটজন কারারক্ষী, জেল সুপারের বাসায় ছয়জন, জেলারের বাসায় ছয়জন এবং ডেপুটি জেলারের বাসায় চারজন কারারক্ষী ব্যক্তিগত কাজে নিয়োজিত আছেন, যা আইন পরিপন্থী।
এই তদন্ত কমিটির প্রধান সৈয়দ বেলাল হোসেন এর আগে চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার পরিদর্শন করে একই ধরনের অনিয়ম পেয়েছেন। তাঁর মতে, সব কারাগারের অনিয়মের ধরন একই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কারাগারে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হিসেবে তদন্তে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেছি। এ ধরনের অপরাধে কারাগারের কর্মকর্তারা কীভাবে জড়িয়ে যান, তা বুঝতে পারি না। রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তাহলে কী করে চলবে! তবে অন্যায় করলে কেউ ছাড় পাবে না। সম্প্রতি কয়েকজন কারা কর্মকর্তাকে আমরা বিচারের আওতায় এনেছি।’
কোন খাতে কত চুরি
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজশাহী কারাগারের ক্যানটিন থেকে মাসিক আয় ১৫ লাখ টাকা হলেও কাগজ–কলমে দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৬ টাকা। এ ছাড়া বন্দী কল্যাণে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৯৮৯ টাকা ও স্টাফ কল্যাণে খরচ দেখানো হয়েছে ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৪৪৪ টাকা। প্রকৃতপক্ষে এই টাকা এসব ক্ষেত্রে খরচ করা হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিধি না মেনে বিল-ভাউচার বানিয়ে খরচ দেখিয়ে সেই টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কারাগারে বিক্রি হয় এমন ৩৫টি পণ্যের মধ্যে ৩৩টির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য নেওয়া হয়। এই অনিয়মের জন্য হিসাবরক্ষক আবুল কালাম আজাদ, ডেপুটি জেলার সাইফুল ইসলাম, জেলার হাবিবুর রহমান ও সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুনকে দায়ী করে বলা হয়েছে, এই টাকা তাঁরা তছরুপ করেছেন। কারারক্ষী নিয়োগেও এই কর্মকর্তারা ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
কারাগারের জমিতে কী পরিমাণ সবজির আবাদ হয়, তার কোনো হিসাব কারও কাছে নেই। পাঁচটি পুকুরে মাছ চাষ করা হলেও তারও কোনো হিসাব রাখা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা হয়। বন্দীদের খাবার হিসেবে ১৪৫ গ্রাম ডাল দেওয়ার কথা থাকলেও ৫০ গ্রাম করে দেওয়া হয়। কেউ নিম্নমানের খাবার দেওয়ার প্রতিবাদ করলে নির্যাতন করা হয়। কারাগারের জমিতে হওয়া গাছের ফল বন্দীদের না দিয়ে বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
তদন্তে উঠে এসেছে, কয়েদি বা বন্দীরা কোনো অন্যায় প্রতিবাদ করলে বা কাউকে জানালে হাত–পা, চোখ বেঁধে তাঁদের নির্যাতন করা হয়। প্রকৃত অসুস্থ বন্দীদের চিকিৎসা না দিয়ে টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সুস্থদের, যাতে তাঁরা আরামে থাকতে পারেন। কারাগারের ভেতরে মাদকসহ নিষিদ্ধ মালামাল প্রবেশ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, কারা কর্মকর্তাদের অনেকেরই নামে–বেনামে সম্পত্তি রয়েছে। রয়েছে একাধিক গাড়ি–বাড়ি, বাস–ট্রাক, ফ্ল্যাটসহ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি। কারারক্ষীদের বিনোদন ছুটি নিতে হলে ডেপুটি জেলারকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। কারারক্ষীদের খেলাধুলা খাতে যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা–ও আত্মসাৎ করেছেন কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে জেলার হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ বিষয়ে ডিআইজি প্রিজনস ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা বলতে পারি যে, সৈয়দ বেলাল হোসেন তদন্ত করে যাওয়ার পর আইজি প্রিজনস, দুদক, মাসুদ স্যার, সুরক্ষা বিভাগের সচিব স্যার সকলেই বিষয়টি তদন্ত করেছেন। তাঁরা সবাই স্যাটিসফাইড।’
তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরও দোষীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা বলেন, ‘রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের যেসব অনিয়মের কথা উঠে এসেছে, তার সত্যতা রয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাজ করছি। আসলেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে তাঁদের বদলি করতে হলে দেখতে হয়, সেখানে কে দায়িত্বে আসবেন বা কোন কারাগারে পদ খালি আছে। তাই ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বিলম্ব হয়।’
একই অভিযোগের তদন্ত কারা অধিদপ্তর করলেও কোনো অনিয়ম খুঁজে পায় না। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের তদন্তে অনিয়ম বেরিয়ে আসে। এমন কেন হয়, জানতে চাইলে আইজি প্রিজনস বলেন, ‘অনুসন্ধান করলে কিছু না কিছু তো উঠে আসেই। এসব দীর্ঘদিনের সমস্যা। তবে আমি চেষ্টা করছি পরিস্থিতির উন্নতি করতে।’ সূত্র- প্রথম আলো