মো. জাহিদ হোসেন:
দক্ষিণ এশিয়া ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং বরাবর আলোচিত-সমালোচিত একটি অঞ্চল। তবে এর রাজনৈতিক ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এর মানবাধিকারের ইতিহাসও। মূলত যখনই বিশ্ব গণমাধ্যমে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সংবাদ প্রকাশ পায় তখনই দুঃখজনকভাবে এখানকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্রটি ফুটে ওঠে। বর্তমানে দেশ হতে দেশ পেরিয়ে সারা বিশ্বেই মানবাধিকারের স্নোগান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এর ঢেউ এসে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়াতেও। তাই এই অঞ্চলের জনগণ আজ তাদের মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ হচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই যেন এই অঞ্চলের দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবপাচার, শ্রমিক সমস্যা, শিশুশ্রম, সীমান্তে হত্যা, গুম, রাজনৈতিকভাবে গ্রেপ্তার-নির্যাতন, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, ক্রসফায়ার, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, পরিবেশগত সমস্যা যেন লেগেই আছে। এই অঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি না পাওয়ায় অনেক সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও প্রতি বছর দেশে দেশে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে কিন্তু কোনো দেশের সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং কিছু ক্ষেত্রে বিচার বিভাগও আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে এখন থেকেই একসঙ্গে।
দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত ও রাজনৈতিক অস্থিরতাময় একটি অঞ্চল। দিন দিন বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে তালেবানের তৎপরতার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, পাকিস্তানে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার প্রাণঘাতী লড়াই, শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহী দমনের ফলে ব্যাপক মানবাধিকার হরণ, ভারতে সমরাস্ত্র তৈরির সাফল্য থেকে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কশাঘাত, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা ও নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা যার প্রমাণ।
গণমাধ্যম ভারতের খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে চরম উদ্বেগজনক সংবাদ প্রকাশ করেছে। কিন্তু পুরো ভারতজুড়ে বর্তমানে তিন হাজারের বেশি মানবাধিকার সংগঠন থাকলেও তারা সেখানে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে করা অভিযোগের খুব সামান্যই গ্রহণ করা হয় বলে জানা যাচ্ছে। ভারতে মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতিতদের মধ্যে শতকরা ৬৪ ভাগই মুসলমান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শ্রীলংকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, শান্তিপূর্ণ সভা ও সংগঠনের অধিকারে বাধা দেয়া। গেল বছরগুলোয় বিচারক এবং আইনজীবীদের ওপর হামলার মাধ্যমে আইনের শাসনকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বিষয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধকালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু শ্রীলংকা সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। শ্রীলংকা সরকার যেসব সামরিক আদালত গঠন করেছিল সেগুলোর প্রয়োজনীয় স্বাধীনতার অভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে অব্যাহতি দিয়েছে। এছাড়া ২০০৬ সালে ত্রিণকোমালিতে পাঁচজন ছাত্র এবং মুত্তরে সতেরো জন মানবিক সেবাকর্মীকে হত্যার মতো অনেক পুরনো অভিযোগের এখনো কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।
এদিকে গেল বছর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই নেপালে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা দিয়ে একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন গঠনের আইন প্রণয়নের বিষয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। কারণ যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাদের দায়মুক্তি দেয়ার অর্থ হলো হাজার হাজার নেপালিকে সত্য এবং ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা; যা শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ উন্মোচনে সহায়ক হবে না। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য এই কমিশন গঠনের লক্ষ্যে নেপালের সরকার একটি আইন পাস করে। এক দশক ধরে চলা ওই সহিংসতায় কমপক্ষে ১৩ হাজার ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে এবং এখনো ১৩০০ জনের বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছে।
বাংলাদেশে জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক হামলাসহ সম্প্রতি গণপিটুনির নামে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের নতুন এক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১৫ সালে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেড়েছে বলে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আসকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেখানে ২০১৪ সালে গণপিটুতে হত্যা করা হয় ১২৩ জনকে সেখানে ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৫ জন। জনগণের হাতে আইন তুলে নেয়ার এসব ঘটনা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
কাশ্মীরের সংঘাতকেও দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম কারণ বলে বিবেচনা করা যায়। এ ক্ষেত্রে ভারত সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের অধীনে সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা। সভ্য বিশ্বায়নের এই যুগে সমগ্র বিশ্ব যখন উন্নতি এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চলেছে, তখনও কাশ্মীরের অধিবাসীদের বিরতিহীনভাবে তাদের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকারের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হতে হয়। তবে ভুটান এই অঞ্চলের সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত।
এখন প্রতিটি দেশই বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ পার্থক্য সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর সব অঞ্চলেই রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিরোধ আছে। কিন্তু সেই বিরোধ জিইয়ে রেখে কেউ অমঙ্গলকে আলিঙ্গন করেননি, যেমনটি করেছেন দক্ষিণ এশীয় নেতারা। বিভিন্ন অঞ্চলের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিরোধ মেটাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো যেভাবে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তারই সফল পরিণতি আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা কেবল একটি কার্যকর অর্থনৈতিক জোটই করেনি, অভিন্ন মুদ্রা ও ভিসাও চালু করেছে। এছাড়া কার্যকর আঞ্চলিক জোট গঠিত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (আসিয়ান), আফ্রিকায় (আফ্রিকান ইউনিয়ন), ল্যাটিন আমেরিকায় (ল্যাটিন আমেরিকান ইকোনমিক কো-অপারেশন)। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা সেরকম কোনো কার্যকর আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা মুখে ঐক্যের কথা বললেও কাজ করেন ঐক্যের বিপক্ষে। সম্ভবত দুটি কারণে দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা সংকটের সমাধান না করে জিইয়ে রাখেন। প্রথমত, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের মধ্যে একধরনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব জাগিয়ে রাখা। দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশীর কাছ থেকে হুমকি আসতে পারে, এই অজুহাতে জনগণকে মৌলিক ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা। তবে অনেক দেশের সেই ক্ষমতাও নেই।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাই সমন্বিত আঞ্চলিক উদ্যোগ ও সহযোগিতাই বেশি প্রয়োজন। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আন্তঃরাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ বিরোধই উন্নয়নের প্রধান বাধা। গণতন্ত্রের স্বার্থে মানবাধিকারের স্বার্থে এই যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটিয়ে পরস্পরকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সব দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সমস্যার সমাধান করতে হবে। একবার জাতিসংঘের সুখ এবং মানসম্পন্ন জীবনবিষয়ক দূত লিও বোরম্যান বলেছিলেন, যে কোনো দেশে মানবাধিকার না থাকলে সেখানে সুখী হওয়া সম্ভব নয়। তবে বিশ্বের অনেক দেশই আছে যেখানে মানবাধিকার থাকলেও মানুষ সুখী নয়। যাহোক, এই অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে আঞ্চলিকভাবে কাজ করার বিকল্প নেই। সব মানবাধিকার কর্মীকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। এই বাধা অবশ্যই দূর করতে হবে। কারো সমস্যা এখানে একার সমস্যা নয়। তাই পারস্পরিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যেতে হবে। আর এর মাধ্যমে একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়বিচার।
লেখক: আইন কর্মকর্তা (সিনিয়র অফিসার), অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড; ই-মেইল: zahidhossainlaw@gmail.com