ত্রুটিপূর্ণ আইনের কারণেই দখল দূষণ থেকে নদী রক্ষায় পরিচালিত প্রথম দফা অভিযান বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আইনের সংশোধন না হলে নতুন করে শুরু করা অভিযানের আশানুরূপ সফলতা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। কারণ কমিশন অভিযান পরিচালনা করতে পারলেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান নেই।
ফলে অপরাধীরা বারবার একই অপরাধ করলেও আইনি দুর্বলতায় পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে কমিশন কাজ করেও সফলতা আসছে না। তাদের মতে, বর্তমান আইনের সংশোধন না হলে সম্প্রতি চালু হওয়া অভিযানও সফলতার মুখ দেখবে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল চলমান আইনে নদীরক্ষা অভিযানের সফলতা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, নদী রক্ষার বর্তমান আইনটি অত্যন্ত দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ। এ আইনে উচ্ছেদ অভিযান কিছুতেই সফল হওয়ার নয়। কারণ আইনে নদী রক্ষা কমিশনকে অভিযানের ক্ষমতা দেয়া হলেও অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার বিধান নেই। ফলে অভিযান পরিচালনাকারীদের সামনে অপরাধ সংঘটিত হলেও তাদের কিছুই করার থাকে না। হাত পা বেঁধে পানিতে সাঁতার কাটতে দিলে যা হয় তাদের বর্তমান অবস্থা তাই।
তিনি নদী রক্ষা নিয়ে চলমান পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণকে ‘অদূরদর্শী ও অসম্পূর্ণ’ আখ্যায়িত করে বলেন, তা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের নদীগুলোর অকাল মৃত্যু ঘটাবে। সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রায়ে তুরাগ ও দেশের অন্যান্য নদীকে জীবন্তসত্তা হিসেবে দেখতে বলা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আইনের সংশোধন করে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নদী রক্ষায় অভিযানের দাবী জানান। নয়তো আকাঙ্খার ‘মুক্ত নদী প্রবাহ’ অধরাই থেকে যাবে বলে মন্তব্য করেন।
তার মতে, চলমান প্রক্রিয়ার ড্রেজিং ও পাড় বাঁধাইয়ের মাধ্যমে যদি বাংলাদেশের নদীগুলোকে ড্রেন কিংবা পানি যাওয়ার রাস্তায় পরিণত করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা নদীমাতৃক দেশের সার্বিক নদী ব্যবস্থাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ফলে বর্ষায় দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে নতুন নতুন এলাকায় বন্যা ও জলাবদ্ধতা মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
বর্তমান আইনের ত্রুটি স্বীকার করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদারের সংশোধন দাবি করেন। তিনি জানান, আইনের দুর্বলতার কারণেই প্রথম দফা অভিযান বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এরপর আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্বিতীয় দফা অভিযান শুরুর পর প্রভাবশালীরা নানাভাবে বাধা দিচ্ছে।
আইন সংশোধনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান আইনে আমাদের অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হলেও আইনি ক্ষমতা প্রয়োগের বিধান রাখা হয়নি। ফলে আমরা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়ে শক্তিপ্রয়োগ করতে পারছি না। তিনি জানান, বর্তমান আইন সংশোধনে কাজ চলছে। এতে নতুন কিছু সংযুক্তিও আসছে। এতে করে অভিযান জোরদার সম্ভব হবে।
তিনি বলেন আইনের দুর্বলতা এ ছাড়া উচ্ছেদ সরঞ্জাম ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবেও অভিযান হোঁচট খাচ্ছে। কারণ অনেক প্রভাবশালীর দখলে থাকা নদী উদ্ধারে গেলে তারা দখলকৃত নদী নিজেদের জায়গা বলে দাবি করে। এ সময় আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে আমরা সে জায়গা পরিমাপ করতে না পারায় চূড়ান্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমন্বিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণা চলছে। এতে করে নদীর জমি কেউ দখলে রাখতে পারবে না।
মুজিবুর রহমান বলেন, নদী দখলকারীদের ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে ধরা হয়। নদী দূষণকারীদের কেবল জরিমানা না করে ক্ষেত্রবিশেষে কারাদণ্ডও দেয়া উচিত। কিন্তু বর্তমান আইনে দূষণকারীরা শুধুমাত্র জরিমানা দিয়েই মুক্তি পেয়ে যায়। কারণ নদী দূষণকারীরা বড় বড় শিল্পকারখানার মালিক। নতুন আইনে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে নদীদূষণের জন্য তাদেরকেও কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।
২৯ জানুয়ারি এ নিয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট নদীদূষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দেয়া এবং অপরাধীদের আরো কঠোর শাস্তি দেয়ার সুপারিশ করেন। তুরাগকে একটি ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করার আবেদনের জবাবে এই রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
এর আগে নদী কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে সারা দেশে ৪৯ হাজার ১৬২ জনের নামে নদী দখলের অভিযোগ করা হয়। এতে বলা হয়, বিগত এক বছরে ঢাকার ৪৭টি খাল জরিপ করা হয়েছে। জরিপকালে সবগুলো খালে অবৈধ দখলদারিত্ব দেখা যায়। অন্তত ১১টি জলাশয়ের ওপর রয়েছে সুউচ্চ ভবন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিয়েল এস্টেটের বালু ভরাটের কারণে হারিয়ে গেছে ভাটারা, ডুমনি-কাঁঠালদিয়া, জোয়ার সাহারা এবং কাঁঠালদিয়া খালগুলো। ধোলাই খালের পানির প্রবাহ গেন্ডারিয়ায় একটি কালভার্ট দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়াও অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি চলে যাচ্ছে কল্যাণপুর, হাজারীবাগ এবং কালুনগর খালে।
কমিশন জানিয়েছে, বালু, ধলেশ্বরী, মধুমতি, আড়িয়ালখাঁ ও কুমার- এ পাঁচটি নদীর ওপরও তারা জরিপ চালিয়েছে এবং প্রতিবেদনে এর ফলাফল বলা হয়েছে। কমিশন সারাদেশে সব মিলিয়ে ৪৮টি নদীর সমীক্ষা করবে বলেও জানিয়েছে।
প্রতিবেদন মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ড এখনো দেশের সমস্ত প্লাবনভূমি শনাক্ত করতে পারেনি। এর কারণে বিনা বাধায় চলছে কলকারখানা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য অবৈধভাবে জমি বরাদ্দ। নদীর বুক থেকে অবৈধ অবকাঠামো অপসারণ করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে অভিযান পরিচালনা করার ক্ষমতা কমিশনকে দেয়া উচিত বলেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। সূত্র: নয়াদিগন্ত