টি. আর. খান
আমার ভাই বাপ্পীকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার বিজ্ঞ বন্ধু ওমর ফারুক বাপ্পীকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের চট্টগ্রামের ৫ হাজার বিজ্ঞ জনের বন্ধু বাপ্পীকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ৫৫ হাজার বিজ্ঞ আইনজীবীর বন্ধু বাপ্পীর জীবন একদল পিশাচ পৈশাচিক কায়দায় কেড়ে নিয়েছে। এভাবে কখনো মেরে ফেলে দেয়া হচ্ছে কখনো হামলা করে রক্তাক্ত করে দেয়া হচ্ছে বিজ্ঞ আইনজীবীদের। আবারো রক্ত ঝরলো আমার একজন ভাইয়ের, আমাদের একজন বন্ধুর। আমাদের বিজ্ঞ বন্ধু বাপ্পী জীবন দিয়ে আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে গেলো আর বসে থাকা যাবেনা।
একজন তরুণ সহাস্যমুখ আইনজীবী আমাদের বাপ্পী। আমাকে তিনি বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। প্রায় প্রতিদিনই তার সাথে আদালতে দেখা হতো। আমাকে দেখলে প্রায়ই জড়িয়ে ধরে বলতেন, সিনিয়র কেউ থাকুন আর না থাকুন আমি আপনার সাথে আছি। জাগ্রত আইনজীবী পরিষদের সকল কর্মসূচিতে আমাকে পাবেন। আমাদের সব কর্মসূচিতে বাপ্পী অংশগ্রহণ করতেন।
গত বৃহষ্পতিবার আমার সাথে তার শেষ দেখা হয়েছিলো। মহানগর অতিরিক্ত দায়রা জজ- ১ এর আদালতে আমার দুটি ওকালতনামা দরকার হচ্ছিলো। আমার পকেটে টাকা ছিলোনা। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বাপ্পী। তাকে ৫০০/- টাকা দিতে বললাম। হাসি মুখে সাথে সাথে বের করে দিলেন। আমি বললাম, বিকেলে ৩ নং বারে আসবেন একসাথে চা খাবো টাকাটাও ফেরত দেবো। বিকেলে বাপ্পী এলেন। আমাকে সালাম দিলেন। আমি বসতে বললাম। তিনি বললেন, সিনিয়র একটু তাড়া আছে, চা আরেকদিন খাবো। আমি ৫০০/- টাকা হাতে দিয়ে বললাম, অনেক ধন্যবাদ। বাপ্পী বারের গেইটে যেয়ে আবার আমার দিকে তাকালেন এবং হেসে দিলেন। আমি হাত দেখালাম। তিনিও হাত দেখালেন। এই হাত দেখানো যে শেষ বিদায়ের তা বোঝার কোন উপায় ছিলোনা।
আমার শরীর ভালো নয়। সর্দি, কাশি এবং ঠান্ডাজণিত কারণে আমি ঘুমুচ্ছিলাম দুপুর পর্যন্ত । আজকে নুয়েসলার পিকনিক ছিলো। সেখানেও যেতে পারিনি। মোবাইল মিউট করে দিয়ে লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছিলাম। দুপুর প্রায় সাড়ে ১২ টার দিকে আমার স্ত্রী বললো, তোমার কাছে অনেক ল’ইয়াররা ফোন করছেন। সিজান ভাই, মাসুদ ভাই, জামশেদ ভাই, হেলাল ভাই, সাইমুল স্যারের সহকারী সালেহ জঙ্গী সহ অনেকেই ফোন করেছেন। আমি শোয়া থেকে উঠলাম। একটু চিন্তিতই হলাম। এতো আইনজীবী বন্ধুদের ফোন! প্রথমেই ঢাকার হেলাল ভাইকে ফোন করলাম। তিনি যখন বললেন, ভাই আপনাদের বারে বাপ্পী নামের একজন আইনজীবীর লাশ পাওয়া গেছে। আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেলো। আমি বললাম, কোন বাপ্পী! মনে মনে ভাবছিলাম আমার প্রিয় ভাই বাপ্পী নয়তো! হেলাল ভাই বললেন, ফেসবুকে দেখুন। আমি সাথে সাথে ফেসবুক ওপেন করলাম। দেখি প্রিয় ভাই মাহিদুল মাওলা মুকুটের স্ট্যাটাস। বাপ্পীর লাশের ছবি। তারপর রণি, রাশেদ, জিয়া, সিজান, আবিদা হীরা সহ অনেক বিজ্ঞ বন্ধুর ক্ষোভে ভরা স্ট্যাটাস। আমি কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কয়েকজনকে ফোন করলাম। সবাই বললেন বাপ্পীকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছে।
প্রিয়ংকাকে বললাম বাপ্পীর খবরটা। প্রিয়ংকা জেনে মুষড়ে পড়লো। এতোটাই মুষড়ে পড়লো যে সে নিজেকে সামলাতে পারেনি। হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। কারণ আমাদের সাথে বাপ্পীর সম্পর্ক ছিলো অসম্ভব আন্তরিকতার। আপন ভাইকে হারিয়ে ফেললে যেভাবে কাঁদে সেভাবেই প্রিয়ংকা আহাজারি করেছে। প্রিয়ংকার কান্না আমার মতো কঠিন চিত্তের মানুষের হৃদয়কে প্রবলভাবে নাড়া দিলো। আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো জল। আমি বিশ্বাস করি প্রিয়ংকার কান্না বাংলাদেশের ৫৫ হাজার বিজ্ঞ বন্ধুর বিবেককে নাড়া দেবে, হৃদয়কে নাড়া দেবে। আমি জানি যারা বাপ্পীকে চেনেন তারা অবশ্যই হৃদয়ে প্রবল আঘাত পেয়েছেন। ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন নিজের অন্তরাত্মায় । আমি প্রিয়ংকাকে সান্ত্বনা দিলাম। বললাম, আমাদের অনেক কাজ আছে। কাঁদলে চলবেনা। প্রতিবাদে, বিক্ষোভে কাঁপিয়ে দিতে হবে চারিদিক। বাপ্পীকে হত্যার বিচার করতে হবে। আর একজন বাপ্পীকেও আমরা হারাতে চাইনা। বিজ্ঞ বন্ধুরা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জাগ্রত আইনজীবী পরিষদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি জানি, বিশ্বাস করি বাপ্পী বাংলাদেশের মহামান্য প্রেসিডেন্টের বিজ্ঞ বন্ধু। বাংলাদেশের মাননীয় আইনমন্ত্রীর বিজ্ঞ বন্ধু। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতির কোর্ট অফিসার। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রভাবিশালী নেতা ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের বিজ্ঞ বন্ধু। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের বিজ্ঞ বন্ধু। বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেত মজুমদার স্যার কিংবা জেড আই খান পান্না স্যার কিংবা শ ম রেজাউল করিম স্যারের বিজ্ঞ বন্ধু। আমাদের মাননীয় জেলা জজ এবং মহানগর দায়রা জজের অফিসার। আমাদের বারের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক স্যারের বিজ্ঞ বন্ধু। বাপ্পীর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আমাদের এই প্রভাবশালী স্যারেরা গর্জে উঠবেন এই আশা আমরা করতেই পারি। আমরা প্রত্যাশা করছি এবং দাবি করছি বাপ্পী হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম বার, ঢাকা বার, খুলনা বার, বাংলাদেশের সমস্ত বার, সমস্ত আইনজীবী সংগঠন কঠোর কর্মসূচী দেবে। সারা বাংলাদেশের ৫৫ হাজার আইনজীবী প্রতিবাদে বিক্ষোভে মুখর করে তুলবে বিচারাঙ্গন। আমরা কর্মসূচী পাবো কর্ম বিরতির। আপনারা কর্মসূচী দিন। বুঝিয়ে দিন বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তে কোন আইনজীবীকে হত্যা করার পরিণাম কি হতে পারে। আমাদের আর দূর্বল করে রাখবেন না। আমাদের আর অসহায় করে রাখবেন না। রাজনীতি করুন তবে সবার আগে নিজের অস্তিত্ব, নিরাপত্তা আর মর্যাদার লড়াই করুন। শুধু দলীয় রাজনীতি নিয়ে নয় নিজের রাজনীতি সবার আগে করুন। নইলে সেদিন বোধহয় আর বেশি দূরে নয় যেদিন আপনি আমি আমাদের আরো কোন বিজ্ঞ বন্ধু খুনের শিকার হবেন।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু হানিফ স্যারকে ধন্যবাদ জানাই। আগামীকাল দুপুর সাড়ে ১২ টায় বাপ্পী হত্যার প্রতিবাদে মানব বন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন চট্টগ্রাম বারের পক্ষ থেকে । আমি আশা করতে চাই আগামীকাল দুপুর সাড়ে ১২ টায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা বাপ্পী হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করবো আমাদের অভিভাবকদের মাধ্যমে। মানব বন্ধন কর্মসূচিতে সকল আইনজীবী অংশগ্রহণ করে তীব্র প্রতিবাদ জানাবেন। পেশাগত ব্যাস্ততা ফেলে রেখে সকল আইনজীবী মানব বন্ধনে অংশ নেবেন। এই উদাত্ত আহবান জানাই সবার কাছে।
এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এটা আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন। বসে বসে তামাশা দেখার কোন সুযোগ নেই। আগে নিজে বাঁচুন, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন, নিজেদের নিরাপদ করুন, নিজেদের হত্যার বিচার করুন তারপর অন্যের ন্যায়বিচার নিয়ে ভাবুন। আমরা আরো কঠোর কর্মসূচী চাই। আমাদের দাবি আগামী সোমবার চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি আদালতে কর্ম বিরতির কর্মসূচী দেবেন। বাংলাদেশের সমস্ত বারে এই কর্মসূচী পালনের জন্য বার কাউন্সিলের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। বীর চট্টলার মাটি এদেশের সমস্ত আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার। বাপ্পীর হত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বার সূচণা করুক আইনজীবীদের সুরক্ষার আন্দোলন। রচিত হোক আইনজীবী সুরক্ষা আইন।
জাগ্রত আইনজীবী পরিষদ সারা বাংলাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচীর ডাক দেবে। সারাদেশের বিজ্ঞ বন্ধুদের আহবান জানাই আসুন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আওয়াজ তুলি। নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য কাঁধে কাঁধ মেলাই। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য একসাথে এক কন্ঠে দাবি তুলি। আইনজীবীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দলমত ভুলে যাই। আমরা আইনজীবী এটাই হোক আমাদের বড় পরিচয়, বড় স্বার্থ। দলীয় স্বার্থের আগে নিজেদের স্বার্থে কাজ করি।
বাপ্পীর মতো এমন নিষ্ঠুর ভাগ্য আমরা বরণ করতে চাইনা। আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হোক। হত্যাকারীদের পক্ষে বাংলাদেশের কোন আদালতে যেন কোন আইনজীবী ওকালতি করতে না পারে সেজন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হোক। চট্টগ্রাম জেলা বারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্ট বারে জানানো হোক যেন হাইকোর্টের বারান্দায়ও খুনীরা যেতে না পারে।
বিজ্ঞ বন্ধুদের কাছে বিনীত অনুরোধ করছি এই পোস্টটি শেয়ার করে সারাদেশের বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছে ছড়িয়ে দিন। সবাইকে সচেতন করুন।
লেখক: আইনজীবী, চট্টগ্রাম আদালত।