চন্দন কান্তি নাথ:
মানুষ সচেতন হলে আইনের প্রয়োগে দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত হলে বাংলাদেশে অপরাধ কমবে| সংবিধান ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁরই কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে গত ২২ শে জানুয়ারি ২০২০ আইনের শাসন নিশ্চিতকল্পে বিচার কাজে গতিশীলতা বাড়ানোর উপর জোর দেন| কেননা আমাদের সংবিধানের ৩৫(৩ ) অনুচ্ছেদে আছে, ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হবেন।আবার একই রূপে যার বিরুদ্ধে অপরাধ তাকেও রাষ্ট্র দ্রুত সঠিক বিচার দিবেন| কেননা আইনের আশ্রয় লাভ ও বিচার পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার| অনুচ্ছেদ ২৭ ও ৩১ আইনের আশ্রয় লাভের কথাটি পরিষ্কার করে আছে| কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না| বিচার ও তদন্তে যথেষ্ঠ দেরি হচ্ছে| আইন এর সঠিক প্রয়োগ হলে তদন্তে ও বিচারে এই বিলম্ব কমবে |
বিচারক কিংবা পুলিশ কিংবা সরকারি আইনজীবী বা আইনজীবী যারাই সরকারি কাজে আছেন এবং যারা বাংলাদেশের নাগরিক তাঁরা আইন মান্য করবেন এবং জনগণের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখবেন এটাই স্বাভাবিক| আমাদের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে আছে – সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিকদায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য৷ সকল সময়ে জনগণের সেবা করবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য৷ পুলিশ একটি তদন্ত ২৪ ঘন্টায় শেষ করবেন এটাই আইনে আছে| ফৌজদারি কার্য বিধি ১৬৭(১) ধারায় আছে – যখন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে হেফাজতে আটক রাখা হয় এবং এটি প্রতীয়মান হয় যে, ৬১ ধারায় নির্ধারিত ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে তদন্ত সমাপ্ত করা যাবে না। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে অতঃপর নির্ধারিত ডায়েরীতে লিখিত ঘটনা সম্পকিত নকল নিকটবতী ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করবেন, এবং একই সময়ে আসামীকে উক্ত ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করবেন। উক্ত ধারায় ২৪ ঘন্টাতে তদন্ত করার কথা থাকলেও পি আর বি ( Police Regulations, Bengal) এর ২৬১ তে আছে তদন্ত কর্মকর্তা বিরতি বিহীন তদন্ত করবেন, ফৌজদারি কার্য বিধির ১৭৩ মোতাবেক সার্কেল এএসপি নিয়মিত তদন্ত কার্যক্রম তদারকি করবেন, যত কঠিন মামলা হোক যদি নিয়মিত তদারকি হয় একটা মামলায় ১৫ দিনের বেশি তদন্ত শেষ করতে লাগবে না | আবার উক্ত বিধিতে আরো আছে – একই ভাবে ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত পাঠালে তা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে হবে, না পারলে ২৬১ মোতাবেক পুলিশ অবশ্যই কেনো পারলেন না এবং কখন পারবেন তার রিপোর্ট পাঠাবেন|
এটা ছাড়া ও সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত দ্রুত করার জন্যে বলতে পারেন |সি আর আর ও ( Criminal Rules and Order, 2009) এর ৭৫(২) বিধিতে আছে – The Magistrate shall impress the investigation officer to complete the investigation as expediciously as possible. উক্ত বিধির ৭৫ (১) অনুসারে যখন পুলিশ ফাইল ম্যাজিস্ট্রেট এর সামনে উত্থাপিত হবে তখনই তদন্তের কেস ডায়েরি উত্থাপন করতে হবে | উপরে উল্লেখিত ফৌজদারি কার্য বিধির ১৬৭ (১) মোতাবেক আসামী আদালতে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে তদন্তের কেস ডায়েরি পাঠাতে হবে বলা আছে | ৫৫ ডি এল আর (হাই কোর্ট ডিভিশন) পৃষ্ঠা ৩৬৩ এর ২০ প্যারাতে ফৌজদারি কার্য বিধির ১৬৭ (১)এর “অতঃপর নির্ধারিত ডায়েরীতে লিখিত ঘটনা সম্পকিত নকল” দিয়ে বুঝিয়েছেন এটা উক্ত ফৌজদারি কার্য বিধির ধারা ১৭২ এর তদন্তের কেস ডায়েরি যা অবশ্যই আসামী কে হাজির করার সময়ই উপস্থাপন করতে হবে|
পি আর বি এর ২১ এ আছে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ এর কাজে হস্তক্ষেপ করবে না কিন্তু যারা cognizance করেন তাদের তদন্ত কার্যক্রমে দায়িত্ব আছে মর্মে স্মরণ করানো হয়েছে |আর বিচারকরা বিচার কাজে সম্পূর্ণ স্বাধীন| সংবিধানের ( Constitution of Bangladesh) ১১৬( ক) তে আছে – এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন ।পুলিশ এর পুলিশ আইন, ১৮৬১ (The Police Act, 1861) এর ২৩(১) (৬) ধারায় আছে – উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত সকল প্রকার বৈধ আদেশ দ্রুত পালন ও কার্যকরী করা ও অপরাধের বৃত্তান্ত অনুসন্ধান বা উদঘাটন করা পুলিশ এর দায়িত্ব |উক্ত আইনের ২৯ ধারায় আছে – কর্তব্যচ্যুতির কোন নিয়ম স্বেচ্ছাকৃত অমান্য করলে ও উপর্যুক্ত কর্তৃপক্ষের বৈধ আদেশ অমান্য করলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি করা যাবে|
আবার তদন্ত শেষ হওয়ার পর আইনে দ্রুত বিচারের কথা আইনে আছে| আইনে সর্বোচ্চ ১৮০ দিনে ম্যাজিস্ট্রেট কে শেষ করার কথা আছে| তবে ফৌজদারি কার্য বিধি এর সঠিক প্রয়োগ হলে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক একটা বিচার ৭ দিন (বিরতি বিহীন) আর সেশন আদালত কর্তৃক ৩৬০ দিনের মধ্য ৬০-৯০ দিনের ভিতর (বিরতি বিহীন) বিচার কাজ শেষ করা যায়| তবে অবশ্যই পুলিশ কে ফৌজদারি কার্য বিধির ১৭১(২) মোতাবেক সাক্ষী নিয়মিত হাজির করতে হবে| আরেক টি বিষয় উল্লেখযোগ্য তা হলো ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট এর কোনো প্রসেস দেয়ার কথা আইনে উল্লেখ নাই কিন্তু সেশন কোর্টে আছে| প্রাসঙ্গিক দুটি ধারা পাশাপাশি পড়লে তা বুঝা যায় | ফৌজদারি কার্য বিধি ধারা ২৪৪(১) এ আছে – ম্যাজিষ্ট্রেট যদি পূর্ববর্তী ধারা অনুসারে আসামীকে দণ্ড দান না করেন, অথবা আসামী যদি উক্তরূপে স্বীকারোক্তি না করে তাহলে ম্যাজিষ্ট্রেট ফরিয়াদীর(complainant) (যদি থাকে) বক্তব্য শ্রবণে অগ্রসর হবেন, এবং বাদী পক্ষের (prosecution) সমর্থনে প্রদত্ত সমস্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন এবং আসামীর বক্তব্যও শ্রবণ করবেন এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে তার প্রদত্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। তবে ম্যাজিস্ট্রেট ফরিয়াদী (complainant) বা আসামীর আবেদন ক্রমে কোন সাক্ষীর প্রতি হাজির হবার অথবা কোন দলিল বা কোন জিনিস হাজির করার নির্দেশ দিয়া সমন ইস্যু করতে পারবেন| একই রূপে ২৬৫ (চ) তে আছে – আসামী যদি দোষ স্বীকার করতে অস্বীকার করে বা দোষ স্বীকার না করে বা বিচার প্রার্থনা করে, অথবা ২৬৫-ঙ ধারা অনুসারে দণ্ড প্রাপ্ত না হয়, তাহলে আদালত সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহণের জন্য একটি তারিখ ধার্য করবেন এবং বাদী পক্ষের (prosecution) আবেদনক্রমে কোন সাক্ষীকে উপস্থিত হতে বা কোন দলিল বা অন্য কিছু আদালতে উপস্থিত করতে বাধ্য করার জন্য যেকোন পরোয়ানা দিতে পারবেন।
প্রসেস দিতে হলেও বর্তমান ডিজিটাল যুগে সহজে সে প্রসেস পুলিশ এর ই মেইল এ পাঠানো যায়| ইতিমধ্যেই পুলিশ অনেক জায়গায় সাক্ষীর মোবাইল নম্বর যুক্ত করছে যা বিচারের সময় সাক্ষী হাজির করার ক্ষেত্রে খুব কাজ দেয়| পুলিশ সাক্ষী না আনলে অথবা সাক্ষী নিজে না আসলে ফৌজদারি কার্য বিধির ৪৮৫ (ক) তে ও সমাধান আছে| তাতে আছে – যদি কোন সাক্ষীকে কোন ফৌজদারী আদালতে হাজির হবার জন্য সমন জারী করা হয় এবং তদানুযায়ী কোন নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে হাঁজির হতে আইনত বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও কোন বৈধ কারণ ব্যতিত হাজির হতে অবহেলা করে বা হাজির হতে অস্বীকার করে অথবা তথা হতে নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বে-আইনীভাবে চলে যায়, তাহলে যে আদালতের নিকট উক্ত সাক্ষী হাজির হতে বাধ্য সেই আদালত যদি বিবেচনা করেন যে ন্যায় বিচারের স্বার্থে এরূপ সাক্ষীর সংক্ষিপ্ত বিচার হওয়া উচিত, তাহলে উক্ত আদালত এরূপ অপরাধ আমলে নিবেন এবং উক্ত অপরাধীকে কেন এই ধারা মতে শাস্তি দেয়া হবে না তার কারণ দর্শাবার সুযোগ দিয়া অনধিক দুইশত পঞ্চাশ টাকা জরিমানা করবেন।
২৬৫ (ছ) তে ধার্য তারিখে আদালত বাদী পক্ষের সমর্থনে উপস্থিত সমস্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করার কথা আছে| আর এভাবে মূল আইনেই দ্রুত তদন্ত ও বিচার সম্ভব| আর তদন্ত ও বিচার দ্রুত না হলেই সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন হয়| সংবিধান এর অনুচ্ছেদ ৩১ এ আছে – আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
তবে আইন অনুসারে বিচারে কাঙ্ক্ষিত গতি আনতে পর্যাপ্ত বিচারকক্ষ, বিচারকের শূন্যপদে নিয়োগ এবং বিচারক ও মোকদ্দমার সংখ্যায় যুক্তিসঙ্গত ভারসাম্য রক্ষা করা এবং তদন্ত কাজে পর্যাপ্ত পুলিশ নিয়োগ আবশ্যক| ইতিমধ্যেই সরকার ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসে ‘পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেসটিগেসন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছে যা প্রত্যেক জেলাতে মামলার তদন্ত করছে। এটি ছাড়াও থানা পুলিশ, ডিবি, সিআইডি ইত্যাদি পুলিশের সংস্থা তদন্ত করছে| আবার আইনমন্ত্রনালয় বলছে বাংলাদেশে এখন নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা প্রায় ১৭০০। অর্থাৎ বিচারকের সংখ্যা ও দ্রুত বাড়ছে| তাছাড়া বাংলাদেশে জেলা আদালত এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টগুলোতে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন পাবলিক প্রসিকিউটররা এবং তাঁদের সহায়তা করেন অতিরিক্ত ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটররা। সেখানেও তাদের সম্মানই বৃদ্ধি কিংবা Attorney Service চালু করে তাদের দায়বদ্ধতা বাড়ানো যায় |
বিচারক, পুলিশ এবং প্রসিকিউটর দের ও আইনজীবী দের ভূমিকার মাধ্যমে প্রচলিত আইন এর সঠিক প্রয়োগে দ্রুত তদন্ত ও বিচার করা যাবে| উপরোক্ত আলোচনা অনুসারে যার যার জায়গায় সবাই নিজ দায়িত্ব পালন করলেই আইন অনুযায়ী দ্রুত তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন হবে| তবে বাস্তবে দেখা যায় বিচারক উদ্যগ গ্রহণ করলে অন্যরা এগিয়ে আসে| কোনো খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় না| ফেনীতে নূসরাত হত্যা বিচার প্রক্রিয়ায় মাননীয় নারী ও শিশু আদালতের একজন বিচারক বিশেষ আইনে ৮৭ সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা গ্রহণ করেন ২৭ জুন-৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অতঃপর আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ২৪ অক্টোবর ফেনীর আদালত রায় ঘোষণা করেন এবং ১৬ জনকে ফাঁসির রায় প্রদান করেন আদালত। এই কেসটি বিশ্বব্যাপী নিউজে কাভারেজ পায়।
তাই আশা করা যায় মামলা অনুপাতে আরো বিচারক ও তদন্তে পুলিশ নিয়োগ পাবে এবং আইন অনুসারে দ্রুত তদন্ত ও বিচার হবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে| বঙ্গবন্ধুর সংবিধান অনুসারে মানুষ দ্রুত বিচার পাবে এবং সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হবে |
লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।