চন্দন কান্তি নাথ:
মোবাইল কোর্ট এর মাধ্যমে বাংলাদেশে তাৎক্ষণিক বিচার করা হয়। কতিপয় অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে নিয়ে দণ্ডারোপের সীমিত ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে গোটা দেশে কিংবা যে কোন জেলা বা মেট্রেপলিটন এলাকায়, ভ্রাম্যমান কার্যক্রম পরিচালিত হয় যাকে “মোবাইল কোর্ট” নামে অভিহিত করা হয়। ফৌজদারি কার্য বিধি এর ৩৫২ ধারা অনুসারে ফৌজদারী আদালতের অধিবেশন এর জন্যে যেকোন স্থানকে উন্মুক্ত আদালত ঘোষণা করতে পারেন। প্রচলিত আদালতে অপরাধী তাঁর দোষ স্বীকার করলে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণের আগেই তাকে সঠিক দণ্ড দিয়ে থাকেন। একই ভাবে যখন কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজের দোষ স্বীকার করেন অথবা নিজের দ্বারা সৃষ্ট দৃশ্যমান অপরাধের অনুতপ্ত প্রকাশের মধ্য দিয়ে দোষ স্বীকার করেন তখন মোবাইল কোর্ট সঠিক দণ্ড দিয়ে থাকে। এতে ন্যায় বিচারের মূলনীতির কোন ব্যত্যয় ঘটে না। আবার মোবাইল কোর্ট এর রায় এর বিরুদ্ধে আপিল ও রিভিশন এর ও ব্যবস্থা আছে।
প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় লাগা, মিথ্যা সাক্ষী উপস্থাপন, বহুমাত্রিক অপরাধ বেড়ে যাওয়া, জনগণের অনুপাতে কম বিচারক থাকা, মামলার জট থাকা, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর মুখ না খোলা, অজ্ঞাতনামা আসামি থাকা, তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও ত্রুটি, অভিযোগনামায় সত্য গোপনের চেষ্টা, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ মুছে ফেলা, আদালতে প্রসিকিউশন অনুপস্থিত থাকা, মামলায় সাজার হার শতকরা ১০ – ১৫ শতাংশ হওয়া, মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতা, গোপন করে এবং জাল কাগজ দিয়ে যে কেউ তার অনুকূলে আদালতের রায় নেওয়া সহ খাদ্যে ভেজাল, ইভটিজিং, ভূমি দস্যুতা, পরিবেশ দূষণ, হাসপাতালে অপচিকিৎসা, সিন্ডিকেট ব্যবসা, অবৈধ ভবন নির্মাণ, মানহীন পণ্য উৎপাদন, গ্যাস ও বিদ্যুত চুরি, অবৈধ ইটভাটা, নদ-নদী দখল, মাদক সেবন ও ব্যবসা, নিষিদ্ধ ইলিশ শিকারসহ ছড়িয়ে থাকা অপরাধের বিরুদ্ধে নিরন্তর স্থানে গিয়ে বিচার করার ক্ষেত্রে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, রমজান ও ঈদের সময় বাজারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে, পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে নকলমুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হওয়ার ক্ষেত্রে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে, মেয়াদ উত্তীর্ণ ও ভেজাল ঔষধ এবং নকল ঔষধ বিক্রি বন্ধ করার জন্য, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, সরকারি খাস জমি, হাট-বাজারের ও রাস্তা-ঘাটের খাসজমি, অর্পিত সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে, ফিটনেস বিহীন যানবাহন চলাচল, বেপরোয়াভাবে যানবাহন চলাচল, ট্রাফিক আইন অমান্যকারী যানবাহন চলাচল বন্ধের ক্ষেত্রে, জুয়া প্রতিরোধ, পরিকল্পিত নগরায়ন, মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ, নোটবই প্রতিরোধ, ওজনে কম দেওয়া প্রতিরোধ, সরকারি প্রয়োজনে ভূমি হুকুম দখল, নিরাপদ পানি সরবরাহ, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ, এসিড নিয়ন্ত্রণ, ধুমপান প্রতিরোধ, সুষ্ঠু সার ব্যবস্থাপনা, কৃষি জমি রক্ষা, শিশুশ্রম প্রতিরোধ, খেলার মাঠ উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ, রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার ভূমিকা যথাযথ নয় |তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মোবাইল কোর্ট এখন বাস্তবতা। তাছাড়া মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সরকারের বিএসটিআই, পিডিবি, বিআরটিএ, ওয়াসা, ডিপিডিসি, রাজউক, বন্দর, তিতাস গ্যাস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বহু প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মোবাইল কোর্ট নিয়ে উচ্ছ্বসিত। গত ডিসেম্বরে ২০১৯ সনে বিচার বিভাগের সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মোবাইল কোর্ট অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিক বিচার পাওয়ার ফলে বিচারিক কার্যক্রমের প্রতি তাদের আস্থা বেড়েছে। মোবাইল কোর্টকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা সম্ভব হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ প্রতিরোধ এবং জনস্বার্থ বিশেষভাবে রক্ষিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এমন একটি অবস্থান আশা করি, যেখানে রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ যথা নির্বাহী, আইন ও বিচারবিভাগ একে অপরের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করবে না। তিনি বিচার বিভাগের প্রতি ও মানুষের আস্থা-বিশ্বাস বেড়েছে মন্তব্য করে বলেন, অনেকগুলো সাহসী পদক্ষেপ যেমন অনেক বাধা অতিক্রম করে জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের রায় দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে এবং এরকম বহু ঘটনার কথা বলা যায় । সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদ ছাড়াও নির্মমভাবে হত্যা হওয়া নুসরাত হত্যার বিচারের রায়সহ অনেকগুলো রায় খুব দ্রুত দেয়ার ফলে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোবাইল কোর্ট এর প্রশংসা এর পাশাপাশি বিচার বিভাগের সক্ষমতা, সক্রিয়তা, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস বেড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি উক্ত সম্মেলনে আরো উল্লেখ করেন -“আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সকলেই ন্যায়বিচার ও আইনের কাছে সমান আশ্রয় লাভ করুক।”
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর বক্তব্য ও উপরের আলোচনা হতে এটি পরিষ্কার মোবাইল কোর্ট এর প্রয়োজনীয়তা ভবিষ্যতে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না এবং আবার সংবিধান অনুযায়ী সকলেই ন্যায়বিচার পাক এটা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চান। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। বঙ্গবন্ধুর এই বাংলাদেশে তিনি সব বিভাগের অঘোষিত অভিভাবক। সেকারণে তিনি সংবিধানের ৭ক (সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ) ও ৭খ ( সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলী সংশোধন অযোগ্য) অনুচ্ছেদে সংবিধান লঙ্ঘন এর বিরুদ্ধে কঠোর ঘোষণা করেছেন।
সেকারণে একদিকে মোবাইল কোর্ট চালু রাখা আবার অন্য দিকে উক্ত কোর্ট যাতে সংবিধান অনুসারে পরিচালিত হয় সে বিষয়টি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা ও ধারণা অনুসারে গুরুত্বপূর্ণ। তবে মোবাইল কোর্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালনা করবে, না বিচারকরা করবে সে সমালোচনা আমাদের দেশে একটি বহুল আলোচিত বিষয়।
অনেকে মনে করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা সংবিধান এর প্রস্তাবনা (….অঙ্গীকার করছি যে… . ও সুবিচার নিশ্চিত হবে ..), অনুচ্ছেদ ৭ (… এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে), ২১( সংবিধান ও আইন মান্য করা,….. প্রত্যেক নাগরিকের ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য), ২২ (রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেন) ,২৫ (… আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা-এই সকল নীতি হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি..) ২৬ (মৌলিক অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য আইন বাতিল), ৩১( আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে), ৩২(আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না) ৩৩( গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ) ৩৫ (বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণ) ১১৬ (অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা) ১১৬ক (বিচারবিভাগীয় কর্মচারীগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন) ,১৫২ (১১৭ ) [আদালত” অর্থ সুপ্রীমকোর্টসহ যে কোন আদালত;] ও আন্তর্জাতিক আইন এর UDHR (Universal Declaration of Human Rights) এর অনুচ্ছেদ ১০, ICCPR (International Covenant on Civil and Political Rights) এর অনুচ্ছেদ ১৪ ও স্বাধীন বিচার বিভাগের পরিপন্থী।
সে কারণে একই আইন বিজ্ঞানের ধারণায় উপমহাদেশের সবখানে মোবাইল কোর্ট বিচারক দিয়ে পরিচালিত হয়। আবার আইনে জ্ঞান কম থাকায় মোবাইল কোর্ট এর মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক স্বেচ্ছাচারি ঘটনা ঘটছে বলে কোনো কোনো মহল সমালোচনা করছেন। তাদের মধ্যে কিছুদিন আগে একজন বিজ্ঞ আইনজীবী, কুড়িকগ্রাম এর জজ কোর্ট এর নাজির ও ক্যাশইআর, মধ্যে রাতে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যান, লক্ষ্মীপুরের সাবেক সিভিল সার্জন, দৈনিক সিলেট বাণী পত্রিকার সাংবাদিক আকবর হোসেন, ১২১ শিশুকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দণ্ড দেওয়া এবং জোর করে রায় এর নকল না দেয়া উল্লেখযোগ্য।
অন্য দিকে মোবাইল কোর্ট বিচারক দিয়ে পরিচালিত হলে বিচারকের জবাবদিহিতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর অধীন আইন মন্ত্রণালয় সহ সুপ্রীম কোর্ট এবং সর্বোপরি জনগণের নিকট থাকে। তাছাড়া নির্বাহী কর্মকর্তারা সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর কর্তৃক সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হয়। তাঁরা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৬ অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত নয় এবং তাঁরা তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এর বাইরে যেতে পারেন না।
তবে সময় ও সমাজের চাহিদার প্রেক্ষিতে যে ভ্রাম্যমান আদালতের সৃষ্টি, যা দৃশ্যমান অপরাধের তাৎক্ষণিক বিচার করতে সক্ষম এবং যাতে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তা বন্ধ করা ঠিক হবে না। এই জন্যে বিচার বিভাগের বিচারক দ্বারা ও মোবাইল কোর্ট চলমান রাখা উচিত। সঙ্গে তাঁদের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট দের মত logistic support ও দেয়া দরকার। কিন্তু পরে পূর্ণাঙ্গ ভাবে আইন ও সংবিধান অনুসারে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগে বিচারকের মাধ্যমে পরিচালিত হলে মোবাইল কোর্ট এর সম্ভাবনা পৃথিবীর জন্যে দৃষ্টান্ত হবে এবং এর সমস্ত সমালোচনা ও বন্ধ হবে। তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা মত আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সকলেই ন্যায়বিচার ও আইনের কাছে সমান আশ্রয় লাভ করবে।
লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।