সাঈদ আহসান খালিদ: বাংলাদেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনব্যবস্থায় ধর্ষণের অপরাধ ভিক্টিমকে বিয়ের মাধ্যমে আপসযোগ্য নয়। এই বিধান ব্রিটিশ আইনের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। এর দার্শনিক ভিত্তিটি হচ্ছে- ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ফলে যদিও ভিক্টিম ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিন্তু মূল ক্ষতিটি আসলে সামষ্টিক অর্থাৎ, এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। তাই ব্যক্তি ক্ষমা করে দিলেও রাষ্ট্র ক্ষমার অংশীদার হতে পারে না, রাষ্ট্রকে সামষ্টিক স্বার্থে বিচারের ব্যবস্থা করতে হয়। এমন বিয়ের মাধ্যমে একজন ধর্ষককে তার অপরাধের ভিক্টিমকে পরবর্তী জীবনব্যাপী ধর্ষণ করার আইনগত বৈধতা দেওয়া হয়; এটি ভিক্টিমের উপর আরেকটি জুলুম- এমন আপত্তিও প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া যেহেতু এই ধরণের বিয়ে স্বপ্রণোদিত নয় বরং বাধ্য হয়ে সম্পাদিত তাই বিয়ে পরবর্তী ভিক্টিমের সত্যিকার দাম্পত্য সুখ ও শান্তি নিশ্চিত না হওয়ার আশঙ্কাই অধিক।
আইনানুযায়ী, ধর্ষণ পরবর্তী বিয়ে হলেও তাতে পূর্বে কৃত ধর্ষণের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তির আইনি সুযোগ নেই। তাহলে ধর্ষকের সাথে ভিক্টিমকে বিয়ে করিয়ে দেওয়ায় আগ্রহের কারণ কী? ধর্ষকের তরফে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে- ধর্ষকের সাথে বিয়ের মাধ্যমে অপরাধী বিচারপ্রক্রিয়া ও শাস্তি এড়াতে পারবে, পারিবারিক বন্ধনে জড়ানোর মাধ্যমে আদালতের সংবেদনশীলতা প্রাপ্তির প্রত্যাশা থাকে, ‘ম্যারিটাল রেইপ’ যেহেতু এখনো বাংলাদেশে আইনি স্বীকৃতি পায়নি তাই অনেকের ধারণা- বিয়ে করে নিলে স্ত্রীর সাথে কৃত যৌনক্রিয়ার মতো একই নারীর সাথে বিবাহপূর্ব কৃত জোরপূর্বক ধর্ষণও বৈধতা পেয়ে যাবে, ভিক্টিমকে স্ত্রী বানিয়ে ফেললে বিবাদী হয়ে সে স্বামীর বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় আর অগ্রসর হবে না, মামলাটি দূর্বল হয়ে পড়বে প্রভৃতি।
অন্যদিকে ধর্ষণের শিকার নারীর আত্মীয়-স্বজন কিংবা স্বয়ং ভিক্টিমদের অনেকে অপরাধীর সাথে বিয়েতে সম্মতি দেন মূলত সামাজিক ও আর্থিক অনিশ্চয়তা থেকে। আমাদের দেশে ধর্ষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ নারীকে উল্টো সামাজিক লাঞ্চনা ও কলঙ্কের সম্মুখীন হতে হয়, ধর্ষণের শিকার নারীর পরবর্তীতে বিয়ে ও সামাজিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে অজস্র প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান, এদেশে বিচারপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া আর্থিকভাবে ব্যয়বহুল, হয়রানিপূর্ণ এবং আইনের নানান প্যাঁচে পড়ে ও ক্ষমতা কাঠামোর প্রভাবে শেষাব্দি ন্যায়বিচার না পাওয়ার সমূহ আশঙ্কা– এসব কিছুই একজন ভিক্টিম কিংবা তাঁর পরিবারকে ‘বিয়ের মাধ্যমে সমঝোতা’ করতে বাধ্য করে।
ধর্ষকের সাথে বিয়ে একটি সামাজিক প্রপঞ্চ এবং মনস্তাত্ত্বিক অনুঘটক তাড়িত কিন্তু আইনে সেটির সুযোগ নেই- এমন প্রতিষ্ঠিত ডিসকোর্স জনমানসে সম্প্রতি বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে যখন বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগ দুটো পৃথক মামলায় ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের নির্দেশ প্রদান করেন। মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে ফেনী কারাগারের সামনে ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার এক নারীর শুভ বিবাহ ইতোমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে। হাইকোর্টের আদেশে কোন ধর্ষকের সাথে কারা ফটকে বিয়ের ঘটনা দেশে এই প্রথম।
হাইকোর্ট নির্দিষ্টভাবে কোন প্রেক্ষাপট ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এমন রায় দিয়েছেন সেটি পূর্ণ আদেশ পড়ার সুযোগ পেলে পরিস্কার হবে। আপাতদৃষ্টিতে এই আদেশ আইনের প্রয়োগ ও প্রতিকারের ক্ষেত্রে প্রচলিত কাঠামোর বাইরে নতুন প্রপঞ্চ ও প্রবণতার উন্মেষ নির্দেশ করে; ‘আইনের সামাজিকীকরণ’- তারমধ্যে সবচেয়ে ব্যঞ্জনাময়। এই আদেশ দুটিকে ‘রেপিস্টের সাথে ভিকটিমের বিয়ের আদেশ’ হিসেবে সরলীকরণ করা সমীচীন হবে না। এই আদেশ নিশ্চয় ব্যতিক্রম। দুটি মামলার ঘটনার বিষয়বস্তু প্রায় একই। মামলা রুজু হয়েছে ধর্ষণের অভিযোগে কিন্তু সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে – ভিক্টিম ও অভিযুক্তের মধ্যে ‘প্রেমের সম্পর্ক’ ছিল, সেই সম্পর্কের ভিত্তিতেই তাদের মধ্যে ‘শারীরিক সম্পর্ক’ হয় এবং একটি মামলায় ভুক্তভোগী অন্তঃসত্ত্বা হন, পরবর্তীতে সন্তান জন্ম দেন। মূলত বিয়ে করতে অস্বীকার করার প্রেক্ষিতেই এ ধর্ষণ মামলা দুটির উদ্ভব। অর্থাৎ, মামলা করার সময়েই বাদীর চূড়ান্ত কাঙ্খিত প্রতিকার ছিল বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন।
অভিযোগকারীর সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিলে আমরা দেখি- প্রেমিক কারাগারে, তিনি এখন সেই প্রেমিকের সন্তানের মা, বিবাহবহির্ভূত সন্তানলাভের কারণে ভিক্টিম সামাজিক ঘৃণা ও গঞ্জনার শিকার, আর্থিকভাবে বিপদাপন্ন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অভিযুক্ত প্রেমিক এখন বিয়েতে সম্মত হয়েছে, সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার করেছে, ভিক্টিম নিজেই আদালতের কাছে দরখাস্ত করেছে- কারাগারে আটক প্রেমিকের সাথে তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করা হোক। অর্থাৎ, ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিয়ের সিদ্ধান্তটি আদালতের স্বপ্রণোদিত প্রতিকার নয় বরং ভিক্টিমের নিজের চাওয়া একটি প্রতিকার।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রচলিত আইন ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ এবং ‘জোরপূর্বক ধর্ষণ’ এর ক্ষেত্রে এখনো আইনগত কোনো পার্থক্য করে না বরং অভিন্ন প্রতিকার নির্দেশ করে। ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ এর ক্ষেত্রে বাদীর মূল চাওয়াই থাকে বিয়ের দাবি এবং সম্পর্কের স্বীকৃতি; অভিযুক্তের শাস্তি নয়। শাস্তির দাবি তখনই উত্থাপিত হয় যখন বিয়েতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে জোরপূর্বক ধর্ষণে ‘জোর’ আছে; ‘প্রেম’ নেই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক পরবর্তী বিয়েতে অস্বীকার করাকে ধর্ষণের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করায় ধর্ষণের মামলা সরলীকৃত হয়ে পড়ছে।
উচ্চ আদালতের আলোচ্য আদেশটি কৌতূহল উদ্দীপক এই অর্থে যে প্রথাগত আইনি পরিধির বাইরে এসে আদালত বাদীর চাওয়া ও তাঁর সামাজিক প্রেক্ষাপটকে প্রাধিকার দিয়েছেন, এর ফলে জোরপূর্বক ধর্ষণ এবং বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ এই দুটোর মধ্যে আইনি প্রতিকারের বেলায় প্রথমবারের মতো পার্থক্য সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছে।
আমাদের আরো মনে রাখতে হবে- জেলগেটে এই বিয়ের মাধ্যমে কিন্তু ধর্ষণের অভিযোগ থেকে অপরাধীর রেহাই মিলছে না কারণ প্রচলিত আইনে ধর্ষণের অপরাধ বিয়ের মাধ্যমে আপসযোগ্য নয়, এখানে ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি বহাল আছে, শুধু জেলগেটে বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে যেটি বাদীর নিজস্ব কাঙ্ক্ষিত প্রতিকার। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে উচ্চ আদালতের যে কোন সিদ্ধান্তগ্রহণের ‘অন্তর্নিহিত ক্ষমতা’ আইনেই আছে। পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী লিবারেলিজমে যে প্রতিকার মানানসই সেটি বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় অকার্যকর ও ফলহীন হতে পারে।
এই আদেশ ব্রিটিশ কলোনিয়াল ল’র সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হলো।
সাঈদ আহসান খালিদ: সহকারী অধ্যাপক; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।