সিরাজ প্রামাণিক: ধর্ষিতা ছন্দা (ছদ্মনাম)। ২০১৩ সালের ৬ জুন দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষকের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেওয়ার জন্য গ্রামের লোকজন চাপ দিতে থাকেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে এ নিয়ে সালিশও হয়। কিন্তু সেখানে অভিযুক্ত যুবক সবকিছু অস্বীকার করেন। সালিশ ভেঙে যায়। প্রতিপক্ষের হুমকির মুখে ছন্দার পরিবার মামলা করতে পারে না। একপর্যায়ে সন্তানসম্ভবা হলে ছন্দাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। তখন ওসিসি থেকেই ধর্ষণ মামলা করা হয়। মামলার পর পুলিশ আসামিকে গ্রেফতার করে।
এরপর ওই যুবক, মেয়ে এবং তার সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় প্রমাণ হয় ওই যুবকই শিশুটির বাবা। আদালতে মামলার বিচার শুরু হয়। আদালত ওই মেয়েটিকে ‘মহিলা সহায়তা কর্মসূচি’র রাজশাহী বিভাগীয় আবাসনকেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেখানে থাকা অবস্থায় মেয়েটির এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা চলাকালে ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন ওই তরুণী। আবাসনকেন্দ্রে থাকতেই এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৪.১৯ পেয়ে তিনি এসএসসি পাস করেন। পরে সেখানে থেকেই এইচএসসি পরীক্ষাও অংশ নেন। পরবর্তীতে ওসিসির আইনজীবী আশুরা খাতুন এবং জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী দিল সেতারার সহযোগিতায় মেয়েটিকে বাড়িতে রেখে আসা হয়। এরই মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এবারও জিপিএ-৩.১৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। এদিকে গত ৩০ মে’২০১৭ আদালতের রায়ে ধর্ষকের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। আদালতের রায়ে সন্তানের দায়ভার বাবাকে নিতে বলা হয়। সেই সঙ্গে বাবার ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
সন্তান হওয়ার কারণে বিবাহিত না হলেও তরুণীটিকে ফেলা হয়েছে বিবাহিত নারীর কাতারে। তিনি নার্সিং কলেজের ফরমই পূরণ করতে পারবেন না। বিয়ে না করলেও তার সন্তান রয়েছে। তাকে এখন বিবাহিত নারী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। অথবা ফরমে তাকে স্বামী পরিত্যক্তা লিখতে হবে। যদিও মেয়েটি কোনো দলেই পড়েন না। এ বিষয়ে গত ১৪ নভেম্বর’২০১৭ একটি জাতীয় দৈনিকে ‘মেয়েটি এখন কী করবে?’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে রিট করেন ফারিহা ফেরদৌস ও নাহিদ সুলতানা জেনি নামক সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী। গত ১১ ডিসেম্বর’২০১৭ বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈবাহিক অবস্থা জানতে চাওয়া কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। একই সঙ্গে ধর্ষণের পর সন্তানধারণকারী ওই মেয়েকে রাজশাহী সরকারি নার্সিং কলেজে ভর্তি করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। যার ভর্তিতে স্বামী পরিত্যক্তা লিখতে হবে-বলে জানিয়েছিল নার্সিং কলেজ কর্তৃপক্ষ।
রাজশাহী সরকারি নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ মনিজ্জা খাতুনের যুক্তি যে, নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষার ফরম পূরণ করার সময় অবশ্যই অবিবাহিত লিখতে হবে অথবা স্বামী পরিত্যক্তা লিখতে হবে। তাছাড়া সন্তান হওয়ার বিষয়টি পরীক্ষায় ধরা পড়বে। এই ক্ষেত্রে মেয়েটিকে স্বামী পরিত্যক্তা লিখতে হবে।
আমাদের সংবিধানে শিক্ষাকে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে শিক্ষার কথা বলা আছে। এ অনুচ্ছেদে মূলত তিনটি বিষয় উল্লেখ আছে। প্রথমত, এখানে আইনানুযায়ী সর্বজনীন, গণমুখি, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা আছে। সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবে। একই সাথে, সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সে প্রয়োজন পুরনের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির ব্যবস্থাও করবে। তৃতীয় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-তা হচ্ছে, দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে।
সংবিধান বলছে, আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমাদের সংবিধান যদিও শিক্ষাকে অধিকারের মর্যাদা দেয়নি। তবে রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষা সাংবিধানিকভাবে অধিকার না হলেও আদর্শিকভাবে অধিকারের মর্যাদাসম্পন্ন। ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার সংবিধানে শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
২০০২ সালে ভারত সংবিধানের ৮৬তম সংশোধনীর আলোকে ২০০৯ সালে ‘শিক্ষা অধিকার আইন’ প্রণয়ন করেছে। সংবিধানের ২১(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তারা এ আইন করেছে। ১৩৫ তম রাষ্ট্র হিসেবে ভারত শিশু শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১০ সালে আইনটি কার্যকর হলে শিক্ষা অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ভারতের এ আইনে ৪ থেকে ১৪ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক৷আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি অনুযায়ী শিক্ষা একটি অধিকার। জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত শিশু সনদেও শিক্ষা অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে শিক্ষার সুফল থেকে রাষ্ট্র বঞ্চিত হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদ ‘গোপনীয়তার অধিকার’ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু ‘ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ’ ও ‘গোপনীয়তার অধিকার’ রক্ষার জন্য বাংলাদেশে বিশেষ কোনো আইন বিদ্যমান নেই।
সম্প্রতি ভারতে সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন। ২৪ আগস্ট’২০১৭ রায়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রশ্নে একই আদালতের আগের দুইটি রায় বাতিল হয়ে যায়। এই রায়ের ফলে জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেন। কারণ রায়ে শরীর ও মনের অধিকার নাগরিকদের বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে দেওয়া জীবনধারণ ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার অংশ হিসেবেই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। ফলে শুধু ভারতীয় নাগরিকরা নন, যে কোনও ব্যক্তি এখন বিচার পাওয়ার আশায় ৩২ ও ২২৬ ধারায় সাংবিধানিক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন।
উপসংহারে বিচারপতি সঞ্জয় কিশান কাউল বলেছেন, গোপনীয়তা একটি মৌলিক অধিকার। ফলে ব্যক্তির জীবনযাপনে রাষ্ট্র বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা দেয়। ঘরের গোপনীয়তা অবশ্যই পরিবার, বিয়ে, জন্মদান ও যৌন অভিযোজনকে সুরক্ষা দেবে।
যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, শিক্ষার অধিকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই। জয় হোক ধর্ষিতার, হৃদয়ে জ্বলে উঠুক শিক্ষার অধিকার, জয় হোক মানবতার, ধর্ষক নিপাত যাক।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক।
মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮