গাজীপুরে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের আড়ালে মাদক ব্যবসা ও অনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রের মালিকসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। একই সাথে তাৎক্ষণিকভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন।
আজ বুধবার (৫ জানুয়ারি) দুপুরে র্যাব-২ এর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘রোগীদের শারীরিক নির্যাতন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় ভর্তি রেখে অর্থ আদায় এবং অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন অভিযুক্তরা। পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে একজন চলচ্চিত্র অভিনেতাসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে।’
র্যাবের মুখপাত্র জানান, গত ১ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতির’ পক্ষ থেকে র্যাব-২ এর কাছে অভিযোগ করা হয়, একজন চিত্রনায়ক দীর্ঘদিন ধরে তাদের কার্যক্রমে অনুপস্থিত রয়েছেন। পরে তারা জানতে পারেন, চিত্রনায়ককে গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব সদর দফতর ও র্যাব-২ এর গোয়েন্দা দল সত্যতা যাচাইয়ে গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। পরে অভিযোগের সত্যতা পায় তারা এবং মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটির ব্যাপক অনিয়মের সম্পর্কে জানতে পারে।
এর ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) বিকালে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-২ এর একটি দল মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিনিধিসহ ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযান চালায়। এ সময় ওই চিত্রনায়কসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করে তারা।
তিনি জানান, এ সময় মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রের মালিক ফিরোজা নাজনিন ওরফে বাঁধন (৩৫) ছাড়াও মনোয়ার হোসেন ওরফে সিপন (৩১), রায়হান খান (২০), দিপংকর শাহ ওরফে দিপু (৪৪) ও জাকির হোসেন আনন্দকে (২৭) গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৪২০ পিস ইয়াবা, নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠি, স্টিলের পাইপ, হাতকড়া, রশি, গামছা, খেলনা পিস্তল ও কথিত সাংবাদিকের পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতার ফিরোজা নাজনিন বাঁধন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি ২০০৯ সালে ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রটি অনুমোদনহীনভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ২০১৩-২০১৪ সালে সাময়িক অনুমোদন পায় প্রতিষ্ঠানটি। তিনি দাবি করেন, এই প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি নিজেই। এর কর্মী ৪ জন এবং রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ২৮ জন। তিনি ভবনটির ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করতেন।
ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলে র্যাব জানতে পারে, ফিরোজা নাজনিন বাঁধন প্রতি রোগীর কাছ থেকে মাসিক চার্জ হিসাবে ১০-৩০ হাজার টাকা করে আদায় করতেন। নিরাময় কেন্দ্রে ২ জন চিকিৎসক থাকার কথা বললেও কোনও চিকিৎসককে সেখানে পাওয়া যায়নি। সেখানে ২০ জন রোগীর চিকিৎসার অনুমোদন থাকলেও ২৮ জন রোগী পাওয়া যায়।
উদ্ধার করা ভিকটিমদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, যেভাবে নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করার কথা, চিকিৎসা দেওয়ার কথা, রোগীদের সেবা করার কথা, তা এখানে করা হয় না। ব্যাপক অনিয়ম এখানে পাওয়া গেছে।
ভিকটিম এবং তাদের স্বজনরা মালিক ফিরোজা নাজনিনের বিরুদ্ধে নিরাময় কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসার নামে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। এখানে চিকিৎসার নামে রশির সাহয্যে ঝুলিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হতো বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন।
ভিকটিম ও কর্মচারীরা জানান, এখানে খাবারের মান অত্যন্ত নিম্নানের। তাছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর যে সব নির্দেশনা দিয়েছে, তা এখানে বাস্তবায়ন করা হয় না। গ্রেফতার নিরাময় কেন্দ্রের মালিক এবং কর্মচারীদের তৎক্ষণিক ডোপ টেস্টে প্রমাণ পাওয়া যায় তারা সবাই মাদকাসক্ত।
উদ্ধার হওয়া চিত্রনায়কের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে আসার বিষয়ে র্যাব জানায়, করোনার সময়ে চলচ্চিত্রের কার্যক্রম স্থবির থাকায় অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে তিনি মানসিক বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ সেবন করতেন। তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হওয়ায় ২০২১ সালের মার্চ মাসে তার মা চিকিৎসার জন্য তাকে ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। মালিকের কথা মতো তাকে সেখানে ভর্তি করান মা এবং চিকিৎসা বাবদ তিন লাখ টাকা পরিশোধ করেন। পরে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা চিকিৎসা খরচ বাবদ মালিককে দেন। মূলত চিকিৎসার নামে তাকে আটকে রেখে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করাই ছিল প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য।
র্যাব জানায়, ফিরোজা নাজনিন বাঁধন ২০০৯ সালে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট। তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর মনোয়ার হোসেন সিপনের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। সিপন তার সঙ্গে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে বসবাস করতেন। কিন্তু তাদের বিয়ের কোনও বৈধ নথিপত্র তিনি দেখাতে পারেননি। তিনি একটি ভূঁইফোড় পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতেন।
গ্রেফতার মনোয়ার হোসেন সিপনের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর। তিনি বাঁধনের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। সিপন ২০১৬ সালে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হন। তার বিরুদ্ধে ২টি মামলা রয়েছে। তিনি মূলত মাদক নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন এবং নিরাময় কেন্দ্রের ঘটনা কাউকে না বলার জন্য ভিকটিমদের ভয়ভীতি দেখাতেন। সিপন ভিকটিমদের যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অপরাধে সহায়তা করতেন।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।