কক্সবাজার আদালতে রামু কোর্টের দায়িত্বরত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তার (জিআরও) বিরুদ্ধে দপ্তরে সংরক্ষিত দৈনন্দিন কার্যতালিকা (কজলিস্ট) এবং মামলার মূল নথিতে ঘষামাজা ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবীর অভিযোগ, নির্ধারিত তারিখে পেন্ডিং থাকা নারাজির দরখাস্ত শুনানীর সুযোগ না দিয়ে বিজ্ঞ আদালতে পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্ট গ্রহণ করাতে এ জালিয়াতি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশাল অংকের টাকার অনৈতিক লেনদেন হয়েছে বলেও অভিযোগ ওই আইনজীবীর।
অভিযোগ ওঠা পুলিশ কর্মকর্তার নাম ইমাম হোসাইন। তিনি পুলিশের এএসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তা। জিআরও ছাড়া জালিয়াতি চক্রের সাথে আরো বেশ কয়েকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এরা হলেন- কনস্টেবল ময়েজ উদ্দিন, বেসরকারী কর্মচারি মনোরঞ্জন নাথ (মনু) এবং রামু উপজেলার উত্তর মিঠাছড়ি ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো: ইউসুফের ছেলে মাহাবুব (২৮)। অভিযোগ আছে মামলার তদন্তকারী দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও।
ইতোমধ্যে জালিয়াতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিতে জেলা পুলিশ সুপার ও কোর্ট ইন্সপেক্টর বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন হত্যা মামলার বাদি রামুর উত্তর মিঠাছড়ি এলাকার মৃত মোস্তাক আহমেদের স্ত্রী রেহেনা আক্তর।
অভিযোগের সারসংক্ষেপ
২০১৯ সালের ৬ মে উত্তর মিঠাছড়ি গাাইনপাড়া এলাকার মৃত হাছন আলী ড্রাইভারের ছেলে ইয়াবা ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন রিক্সায় উঠাকে কেন্দ্র করে কিল ঘুষি, হাতুড়ি দিয়ে মারধর করে তার স্বামী রিক্সা চালক মোস্তাক আহমদকে। এ ঘটনায় আহত মোস্তাক বাদী হয়ে রামু থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। ৯ মে আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেই মারা যান তিনি। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে সাদ্দামকে একমাত্র আসামী করে সিনিয়র জুডিসিয়াল আদালত নং-১ রামু আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আদালত অভিযোগটি নিয়মিত মামলা হিসেবে নথিভূক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য রামু থানাকে নির্দেশ দেন। মামলা তদন্ত করেন তৎকালিন রামু থানার এসআই মামুন ইসলাম। তিনি আসামীর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নামে মাত্র তদন্ত করে মাত্র ১৩ দিনের মাথায় একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে সুপারিশের জন্য পুলিশ সুপারকে জমা দেন। কিন্তু প্রতিবেদনটি অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন তৎকালিন এসপি। এরমধ্যে বদলি হয়ে অন্যত্রে চলে যান মামুন। মামলটির দ্বিতীয় দফায় তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় এসআই মোহাম্মদ আমির হোসেনকে। তিনি কোন প্রকার তদন্ত না করে পূর্বের অফিসারের তদন্ত অগ্রগতি করেন মাত্র। মামলাটি তথ্যগত ভুল দাবি করে আসামীকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করে ২০২০ সারের ২০ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন এসআই আমির হোসেন। ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি আদালত ৯ নং আদেশে চূড়ান্ত রিপোর্ট তথ্যগত ভুল প্রতিবেদন পাওয়ার কথা উল্লেখ করে মূল ভিসেরা রিপোর্ট এবং অন্যান্য কিছু বিষয় তলব করেন। ২১ জানুয়ারি প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদীর আইনজীবী নারাজি দরখাস্ত দাখিল করেন। কিন্তু করোনাকালীন সময় চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজির শুনানী হয়নি। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর নারাজি দরখাস্ত শুনানীর জন্য হাজিরা দাখিল করা হলে আদালত ২০ ডিসেম্বর পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেন। রামু আদালতের জিআরও অফিসের সংরক্ষিত কজলিস্টে ১১ অক্টোবরের পাতায় মোট ২৬টি মামলার মধ্যে মোস্তাক হত্যা মামলাটি (জিআর-৩০৮/১৯) ৬ নং ক্রমিকে ছিল। যার পরবর্তী ধার্য দিন ছিল ২০ ডিসেম্বর। কিন্তু অত্যন্ত সুচতুর জিআরও ইমাম হোসাইন অফিসে কর্মরত কনস্টেবল ময়েজ উদ্দিন, বেসরকারী কর্মচারি মনোরঞ্জন নাথ (মনু) এবং রামু উপজেলার উত্তর মিঠাছড়ি ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো: ইউসুফের ছেলে মাহাবুবসহ পরস্পর যোগসাজসে ২০ ডিসেম্বর তারিখ ঘষামাজা করে পরিবর্তন করে ১০ নভেম্বর দেখিয়ে আদালতকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করিয়েছেন।
বাদীর আইনজীবীর বক্তব্য
বাদীর আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে হত্যা মামলা থেকে আসামীকে রক্ষার কুমানসে কজলিস্টে ঘষামাজা করে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। একই কান্ড ঘটিয়েছেন মূলনথিতেও। একই সাথে পরবর্তী দিন দেখানো হয়েছে ২০২২ সালের ২৯ জানুয়ারি। যা নথির ১৫ নং আদেশ দেখলে স্পষ্ট প্রতিয়মান হবে। প্রকৃত পক্ষে এ মামলার পরবর্তী ধার্য দিন হবে ২০ ডিসেম্বর। কিন্তু অভিযুক্তরা অসৎ উদ্দেশ্যে ন্যায় বিচার থেকে বাদীকে বঞ্চিত করতে ঘষামাজার জালিয়াতি করেছে। নারাজী শুনানী করা গেলে চূড়ান্ত রিপোর্ট তথ্যগত ভুলের দরুন খুনের মামলার আসামী কখনো অব্যাহতি পেতেন না বলে মনে করেন বাদীর আইনজীবী।
তিনি বলেন, চূড়ান্ত রিপোর্ট তথ্যগত ভুলের অর্থ অব্যহতি নয়, ভিন্ন কোন অপরাধ স্বীকৃত। আমরা হত্যা বা খুন দাবি করেছি সেটি না হয়ে ভিন্ন অপরাধ হতে পারে। সেটিও একটি অপরাধ। তাহলে কিসের ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামীকে অব্যহতির সুপারিশ করেছেন আমি বুঝতে পারছি না।
তিনি আরো বলেন, আমরা নারাজি শুনানীর জন্য নির্ধারিত দিনের অপেক্ষা করছি। এর আগেই মামলা থেকে অব্যহতি পেয়েছে দাবি করে আসামী সাদ্দাম এলাকায় গিয়ে বাদীকে হুমকি দিচ্ছে। বিষয়টি জানার পর জিআরও অফিসে গিয়ে জালিয়াতির তথ্যের বিষয়টি জানতে পারি। তাই দ্রুত জালিয়াতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে জেলা পুলিশ সুপার ও কোর্ট ইন্সপেক্টর বরাবরে অভিযোগ দিয়েছে বাদী। যেখানে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হওয়ার কথা সেখানে জালিয়াতির বিষয়টি মেনে নেয়ার মতো না। এটি ঘৃণ্য অপরাধ বলে মনে করেন তিনি।
অভিযোগ বিষয়ে যা বললেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রামু কোর্টের জিআরও এএসআই মো: ইমাম হোসাইন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, এ অভিযোগ সত্য নয়। নথি সংক্রান্ত পরিবর্তন, পরিমার্জন কিংবা ঘষামাজা বা জালিয়াতির যে অভিযোগ করা হয়েছে সেই এখতিয়ারই আমার নেই।
ইমাম হোসাইন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে আরও বলেন, আমার দায়িত্ব আদালতে নথি উপস্থাপন করা। আমি সেই কাজটিই করেছি। এরপর বিজ্ঞ আদালত নথি পর্যালোচনা করে যা ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছে সেভাবেই প্রকাশ্য আদালতে আদেশ দিয়েছেন।
এদিকে জিআরও ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে কোর্ট ইনস্পেক্টর চন্দন কুমার সাহা বলেন, অভিযোগ তদন্ত পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এসপি স্যারের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, এখনো অভিযোগ হাতে আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।