সিরাজ প্রামাণিক: কেউ আপনার স্থাবর বা অস্থাবর জমি-জমা সহায় সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করতে চাইলে কিংবা বেদখল হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হলে কিংবা আপনার দখলকৃত জায়গা কেউ অন্যত্র বিক্রির চেষ্টা করলে কিংবা শরীকান সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা বাদেই কেউ বিক্রির অপচেষ্টা করলে আপনি এসকল কাজ বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন। নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্তির পরও কেউ নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনী শাস্তির ব্যবস্থাও করতে করতে পারেন।
শুরুতেই একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনাটি শুরু করতে চাই। কবির চৌধুরী সরকারী চাকুরে। একখন্ড জমি কিনে ১২ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখল করে আসছিলেন। হঠাৎ একদিন তিনি শুনতে পেলেন একই গ্রামের জোতদার শফিক মিয়া শিগগিরই তিনি তার লোকজন নিয়ে জমিটি দখল করতে আসবেন। কবির চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন জোতদার শফিক মিয়ার কাছে। তিনি সাফ জানিয়ে দেন এ জমি তার বাবা কিনেছিলেন এবং শফিক তার বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে জমিটির মালিকানা লাভ করেছেন এবং এখানে কারও কোনো অধিকার নেই। চৌধুরী সাহেব হতবিহব্বল হয়ে পড়লেন। কি করবেন এখন চৌধুরী সাহেব?
চৌধুরী সাহেব আদালতের সামনে পুরো ঘটনা উপস্থাপন করে আরজি দাখিল করলে ঘটনার সব অবস্থা বিবেচনা করে আদালত বিবাদীকে ওই জমিতে প্রবেশ করতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন। মামলায় জড়িত কোন পক্ষ কর্তৃক মামলা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি বিনষ্ট, ধ্বংস বা হস্তান্তর হওয়ার আশংকা দেখা দিলে অথবা কোন ডিক্রি জারির দরুন বেআইনিভাবে বিক্রয় হওয়ার উপক্রম হলে অথবা বিবাদী তার পাওনাদারকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে তার সম্পত্তি অপসারিত বা হস্তান্তরিত করার ইচ্ছা প্রকাশ বা হুমকি প্রদর্শণ করলে আদালত অনুরূপ কাজ রোধ করার জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিতে পারেন।
নিষেধাজ্ঞার প্রধানত দুই প্রকার হতে পারে। একটি স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা অপরটি অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা। স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা অনন্তকালের জন্য চলতে পারে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, রহিম মিয়ার জমির উপর দিয়ে আজিজ মোল্লা জোর করে রাস্তা বানাতে চায়। এখানে কখনও রাস্তা ছিল না। এই জমি পৈত্রিকসূত্রে মালিক রহিম মিয়া। মামলা করে আদালত থেকে রহিম মিয়া স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পেতে পারে যে, তার জমির উপর দিয়ে রাস্তা বানানো যাবে না। আর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার জন্য কোন আলাদা মামলা দরকার হয় না। কোন মামলা করা থাকলে পার্শ্ব প্রতিকার হিসাবে ইনজাংশনের দরখাস্ত দিয়ে শুনানি করে ইনজাংশন পাওয়া যায়। আরেকটি নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যখন বুঝিতে পারেন যে, গণ-উপদ্রব গুরুতর আকার ধারণ করতে যাচ্ছে অথবা এমন মারামারি বা দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, সে অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধার জারি করিতে পারে।
এছাড়া দখল ও বেদখলকে কেন্দ্র করে শান্তি শৃঙ্খলার অবনতি এমনকি রক্তারক্তি, খুন, জখমের সম্ভাবনা থাকে। এসব থেকে রক্ষা পেতে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৫ ধারার মামলা দায়ের করা যায়। তবে ১৪৫ ধারায় মামলা দায়ের করতে হলে অবৈধভাবে বেদখল হওয়ার ২ মাসের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। সেইসাথে নিরংকুশ মালিকানা স্বত্ব বিদ্যমান থাকতে হবে। আর মনে রাখা উচিত যে দীর্ঘদিন বেদখলে থাকলে এবং সম্পত্তি দখলে না থাকলে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারার মামলা করা যায় না। সেক্ষেত্রে ডিক্লারেশন স্যুট করে টাইটল প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আবার ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৫ ধারা মতে আদালত আদেশমূলক নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন। আদেশমূলক নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হল নালিশি সম্পত্তি বা বিষয়বস্তুকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। কেউ যদি অন্যায়ভাবে বাদীর সম্পত্তির বিনষ্ট করে তাহলে আদালত এ আদেশ দিতে পারেন। আবার কারো অধিকার রক্ষা বা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কোনো দূর্ঘটনা সংঘটন বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যেন বেড়ে না যায় আদালত সেই জন্যও নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ দিতে পারেন।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ধরুন, আপনার প্রতিবেশী বাড়ি নির্মাণ করছেন। তার বাড়ির ছাদের প্রান্তভাগ এমনভাবে তৈরী করছেন যা আপনার জমির উপর প্রসারিত করে ফেলেছে। আপনার নিষেধ সত্ত্বেও নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আপনার ওই প্রতিবেশী আপনার জমির উপর যতখানি ছাদের প্রান্তভাগ তৈরী করেছে, ততখানি ভেঙ্গে ফেলার জন্য আপনি ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৫ ধারা মতে আদেশমূলক নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করতে পারেন।
একটি বিষয় আপনাদেরকে জানিয়ে রাখি যে, বাদীপক্ষ যদি আদালতকে ভুল তথ্য দিয়ে, নকল দলিল প্রদর্শণ করে বা প্রতারণামূলকভাবে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আদেশ আদায় করে এবং পরবর্তীতে যদি বিষয়টি প্রমাণিত হয় তাহলে বিবাদী পক্ষ দেওয়ানী কার্যবিধির ৯৫ ধারা মতে ক্ষতিপূরণ পাবে। নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুরকারী আদালতই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার শাস্তি দেয়ার এখতিয়ার রাখে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে আদালত দোষী ব্যক্তির সম্পত্তি ক্রোক করার নির্দেশ দিতে পারে এবং ওই ব্যক্তিকে অনধিক ছয় মাস মেয়াদের জন্য দেওয়ানি জেলে আটক রাখার নির্দেশ দিতে পারে কিংবা জরিমানার ব্যবস্থাও করতে পারেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com