'কোর্ট ম্যারেজ' এর আইনগত ভিত্তি ও করণীয়
অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী

সাইবার অপরাধ ও প্রাসঙ্গিক কথা

মো. রায়হান আলী: আধুনিক বিশ্বায়নে জীবন-যাপন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর। এই প্রযুক্তিগত জীবন-যাপনে অনেকাংশে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে সাইবার অপরাধ। দিন দিন বেড়েই চলছে এ অপরাধ। যেন আধুনিকতার অগ্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে এ অপরাধের ধরনেরও পরিবর্তন হয়ে জ্যামিতিকহারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ প্রবণতা।

সাইবার অপরাধ হল মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক অপরাধ। সাইবার অপরাধ বা কম্পিউটার অপরাধ এমন একটি অপরাধ যা কম্পিউটার এবং কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাথে সম্পর্কিত। কম্পিউটার একটি অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে বা এটা নিজেই লক্ষ্য হতে পারে।

সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত বিশ্লেষক দেবারতি হালদার ও কে জয়শংকর সাইবার অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছেন “আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক, যেমন ইন্টারনেট (চ্যাট রুম, ইমেল, নোটিশ বোর্ড ও গ্রুপ) এবং মোবাইল ফোন (এসএমএস কিংবা এমএমএস) ব্যবহার করে, অপরাধমূলক অভিপ্রায়ে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে সম্মানহানি,কিংবা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি/ক্ষতির কারণ হওয়া”।

এ ধরনের অপরাধ একটি জাতির নিরাপত্তা ও আর্থিক স্বাস্থ্য হুমকি হতে পারে। আমাদের প্রতিনিয়তই ইন্টারনেট সেবা এখন অনেক প্রেক্ষাপটে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইন্টারনেট শিশু-কিশোর থেকে বয়বৃদ্ধরাও ব্যবহার করে থাকে।

বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা অন্যান্য বয়সের ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এ বিষয়ে তাদের দক্ষতাও আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম।

গবেষণা বলছে, একজন মানুষ দিনে অন্তত ২৬৬৪ বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিণ স্পর্শ করে। আর এই স্ক্রিণ স্পর্শ করার কারণ ফোনের নোটিফিকেশন চেক, কোন এসএমএস আসলো কিনা ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করে। অল্পবয়সীরা লেখাপড়ার প্রতি মনোনিবেশ না করে দিনে দিনে ঝুকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অপব্যবহারে।

বর্তমানে যারা দ্রুত ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছর অর্থাৎ তরুণ সমাজ। এদের মধ্যে প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, এবং পৃথিবীতে প্রায় ২২০কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে। বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ, যাদের মধ্যে ১০ কোটি ৩২ লাখ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট এর সাথে যুক্ত। এই বিশাল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজী নামক ভিডিও গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ।

ইন্টারনেটের এমন ব্যবহার শুধু শিশু-কিশোররা নয় সব বয়সীরাই ব্যবহার করছে। এমন ইন্টারনেট ব্যবহারে অসতর্কতার কারনে সাইবার অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। অনায়াসে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী কারো পোস্টে লাইক, কমেন্ট কিংবা শেয়ার করে বসে। কিন্তু অনেকেই সঠিক বিচার বিশ্লেষণ না করেই এসব করছে।

এছাড়াও অনেকে না বুঝে ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াট্স অ্যাপ, ইমোসহ এ ধরণের অ্যাপ ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান প্রকার ভিডিও আপলোড, লাইক, কমেন্ট, ম্যাসেজিং, শেয়ার করে বসে। পাশাপাশি অনেকে ইচ্ছা করে কিংবা কারো সাথে মজা করে অন্যের পরিচয় প্রতারণা করে বা ছদ্মবেশ ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ফেইক আইডি তৈরি করে প্রতারণা করছে।

পরবর্তীতে হয়তবা দেখা যায় এর ফলে কারো বিরুদ্ধে মানহানি, কটূক্তি কিংবা অপপ্রচারের শামিল হয়ে গেছে। ব্যস, ফেঁসে গেল সাইবার অপরাধে। অনেকে সরল বিশ্বাস বা অজান্তেই সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছে। বর্তমানে হ্যাকিং, কপিরাইট লঙ্ঘন, শিশু পর্নোগ্রাফি, অনলাইন ভিত্তিক প্রতারণার মতো অপরাধগুলো উচ্চমাত্রায় বাড়ছে। আন্তর্জাতিকভাবে, রাষ্ট্রীয় বা অ-রাষ্ট্রীয় সত্তা কর্তৃক গুপ্তচরবৃত্তি, আর্থিক প্রতারণা, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, কিংবা অন্তত একটি রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত এরূপ বিষয়ে হস্তক্ষেপ জনিত সাইবার অপরাধকে সাইবার যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

ক্রাইম সার্ভে অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাজ্যে ২০১৯ সালে ৩৮ লাখ অনলাইন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, যা দেশটিতে মোট অপরাধের এক-তৃতীয়াংশ। ২০১৭ সালে দেশটি এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ শুরু করার পর থেকে প্রতিবছর সাইবার জালিয়াতির ঘটনা বাড়তে দেখেছে। সেখানে প্রায় ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এ জালিয়াতির শিকার হন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি মানুষ এক হাজার ডলারের বেশি অর্থ খুইয়েছেন। যুক্তরাজ্যের মতোই অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের। গত বছর দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণা ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণায় গত বছর মোট লোকসান হয়েছে ৪২০ কোটি ডলার, যা ২০১৭ সালের তুলনায় তিন গুণ বেশি।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা হু হু করে বেড়েই চলছে। এ অপরাধের রাশ টেনে ধরতে সরকার নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। প্রথমে সাইবার অপরাধের বিচার করার জন্য একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল ঢাকাতে ছিল। পরবর্তীতে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে সরকার ২০২১ সালে আরো ৭টি সাইবার ট্রাইব্যুনাল যুক্ত করে। তাতে মোট সাইবার ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা দাড়ায় ৮টি। আর বর্তমানে বিভাগীয় শহরে অবস্থিত এই আটটি ট্রাইব্যুনাল হচ্ছে- ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল, খুলনা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, বরিশাল সাইবার ট্রাইব্যুনাল, সিলেট সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল।

এই ট্রাইব্যুনালে বিচার্য অপরাধসমূহ সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত-২০১৩) এ সংযোজিত ধারায় ২০১৮ সালের আগে বিচার করা হত। কিন্তু পরবর্তীতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬(সংশোধিত-২০১৩) এর কিছু ধারার সংশোধন ও বাতিল সাপেক্ষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ করা হয়। আর সে মোতাবেক ট্রাইব্যুনালগুলোতে সাইবার অপরাধের বিচার কাজ চলছে।

নতুন এই আইনে অপরাধের শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুনঃ অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কার্যকর হয়েছে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর। এর পরের তিন বছরে এ আইনে মামলা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৬৫৭ টি। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট মামলা এসেছে দুই হাজার ৬৪২টি৷ প্রতিবছরই মামলার সংখ্যা বেড়েছে৷ ২০১৯ সালে ৭২১টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে এসেছে ৩টি মামলা৷ চলতি বছরে ২৫৬টি মামলা হয়েছে৷

এখন পর্যন্ত সরাসরি ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা হয়েছে ১ হাজার ৮২টি মামলা৷ এরমধ্যে ৪৪৭টি মামলায় বিভিন্ন সংস্থাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল৷ বাকি ৬৩৫টির প্রয়োজনীয় উপাদান না থাকায় আদালত খারিজ করে দেন৷ ৪৪৭টির মধ্যে ১৫০টি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে আদালতে জমা হয়েছে৷ বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে সব মিলিয়ে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দুই হাজার ২১টি।

সাইবার অপরাধ একটি দেশ ও জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। সাইবার অপরাধের রাশ টেনে ধরতে সরকারকে আরো উদ্যোগ বাড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও আরো সচেতন হতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার যখন আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় তখন এই ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের আরো বেশি জানতে হবে।

লেখক: আইনজীবী; জজ কোর্ট, খুলনা।