ব্যারিস্টার তমিজ উদ্দিন আহমেদ :
সময়ের আবর্তনে আবারও এসেছে একটি দিন- যেদিন জন্মেছিলেন এ ভূখণ্ডের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান, ইতিহাসে যিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন কিংবদন্তি হিসেবে। এদিন জাতি শুধু স্মরণ নয়, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় যার অবদানের কথা স্বীকার করে থাকে, তিনি হচ্ছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ।
বিগত শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষের দিকে তিনি জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। উচ্চ মেধাসম্পন্ন মাহবুব মোর্শেদ ছাত্রজীবন থেকে বেড়ে উঠেন বাধ্যতামূলক নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে, যা তাকে শুধু ঈর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারীই করেনি, প্রেরণা এবং সাহায্য করেছে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মানিত এবং মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল অর্জন করতে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘দ্য অনারেবল সোসাইটি অব লিংকন ইন’ থেকে ১৯৩৮ সালে।
পেশাগত জীবনে তার কঠোর পরিশ্রম ও অসামান্য মেধা তাকে নিয়ে গেছে খ্যাতির শীর্ষে। ১৯৫৪ সালের শেষদিকে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে যোগ দেন এবং একই বছর ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক পদে নিযুক্ত হন। বিচারপতি মোর্শেদ পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৪ সালে তিনি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি নিন্ম আদালতের ব্যাপক উন্নয়ন করেন। সামাজিক ন্যায়বিচার ও স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য তার গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে তার কিছু ঐতিহাসিক রায় এবং সাংবিধানিক ব্যাখ্যা উপমহাদেশের পরিধি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
আইন পেশায় সুখ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক কঠিন সময়ে বিচারপতি মোর্শেদ এগিয়ে এসেছিলেন এবং দায়িত্ব নিয়েছিলেন একজন অকুতোভয় বীর সৈনিকের মতো। তার দূরদর্শী চিন্তা, মেধা, পরিশ্রম এবং সোচ্চার ভূমিকার জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী মহলের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিল।
ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভের পর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন এবং শোষণের বিপরীতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এবং ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বলা হয়ে থাকে, ২১ দফা দাবির প্রথম খসড়াটি তিনিই প্রণয়ন করেন। বিচারপতি মোর্শেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়ই ১৯৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলনের ৬ দফা দাবি প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালে যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সে সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব মুজিবুর রহমানকে এই স্বাধিকার আন্দোলনের ৬ দফা দাবির জন্য পাকিস্তানের কারাগারে কারাভোগ করতে হয়েছিল।
বিচারপতি মোর্শেদ তার জীবনকালে শুধু ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না, তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। বিচারপতি মোর্শেদের পেশাগত সুখ্যাতি, ব্যক্তিত্ব, উচ্চ মর্যাদাশীল হওয়া সত্ত্বেও সাধারণের সঙ্গে অংশগ্রহণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা ও অবস্থান গ্রহণের গুরুত্ব জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়েছিল। ঐতিহাসিক ‘নেহেরু-লিয়াকত’ চুক্তি প্রণয়নেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আইয়ুব খানের ঐতিহাসিক গোলটেবিল বৈঠকে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তানের যে ৩৫ নেতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। সে বৈঠকে বিচারপতি মোর্শেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ইতিহাসবিদদের মতে, সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ বাঙালি যে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি- সেটাই শুধু প্রমাণ করেননি, তিনি তার দেয়া প্রস্তাব ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’-এর দাবি সামরিক জান্তাদের রক্তচোখের সামনে থেকে ছিনিয়ে আনেন। এর আগে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের সমান সংখ্যক আসন নির্ধারিত ছিল। মাহবুব মোর্শেদের দেয়া প্রস্তাব ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি গ্রহণের ফলে নির্ধারিত ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০ থেকে বেড়ে ১৬৯টিতে। রাজনৈতিকভাবে এ আসন সংখ্যার বিভাজনটি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে পরাভূত করে, যার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৭০-এর নির্বাচনে। বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের এ অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আয়ুব খান তার সামরিক শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করে, সে সময় বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জনতার কাতারে এসে দাঁড়ান। বিচারপতি মোর্শেদ গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করতেন এবং এগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেন। তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের মর্যাদা অক্ষুণ রাখার চেষ্টা করেছেন এবং সফলতাও অর্জন করেছেন।
মাত্র পাঁচ দশক আগে যখন আমাদের এ ভূখণ্ডটি হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ভিনদেশি শাসকগোষ্ঠী শাসনের নামে শোষণ চালাত, সিদ্ধান্ত নিত- কী হবে আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা! এসবই ছিল একটি জাতির জন্য চরম অপমানজনক। এ অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে মাহবুব মোর্শেদ তার সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ প্রধান বিচারপতির আসন থেকে পদত্যাগ করেন, যা ছিল নজিরবিহীন। বস্তুত তার পদত্যাগ ছিল সে সময় ‘talk of the country’। অনেক ঐতিহাসিক এবং সমাজ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তার পদত্যাগপত্রটি ছিল সে সময়ে সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের জন্য একটি চপেটাঘাত।
প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার পর প্রথমেই তিনি মনোযোগ দেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের পক্ষে মামলার প্রস্তুতি গ্রহণে এবং পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গঠন করেন। জনমত গঠন করার মধ্য দিয়ে মাহবুব মোর্শেদ রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। তিনি সামনে থেকে আইন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপক ‘আইয়ুববিরোধী আন্দোলন’ (Anti-Ayub Movement) গড়ে তোলেন। সে সময়ের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব আসামির মুক্তির জন্য সভা, সমাবেশ, সেমিনার এবং আন্তর্জাতিক মহলে আবেদন জানান। তার এ অবদানের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে কখনও মুছে যাবে না। তিনি আমাদের হৃদয়ে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন অনন্তকাল।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী আইনজীবী ও গবেষক। কৃতজ্ঞতা – যুগান্তর