মোঃ মুস্তাকিমুর রহমান : বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি। আর আদালত হচ্ছে বিচার বিভাগের দৃশ্যমান রূপ, যার মাধ্যমে অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা হয় এবং অস্পষ্ট আইনের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এক কথায় বলতে গেলে সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয় হচ্ছে আদালত। পুলিশ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের অধীনে হলেও বিচার বিভাগের সাথে সরাসরি সংযুক্ত থাকে বিভিন্ন কারনে। বিশেষ করে ফৌজদারি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় পুলিশের গুরুত্ব অপরিসীম।
ফৌজদারি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় পুলিশ যেমন আদালতের বাইরে অনেক কাজ করে ঠিক তেমনি আদালত প্রাঙ্গণে কিছু পুলিশ নিয়োজিত থাকে বিচারকদের বিচার কাজে সাহায্য করার জন্য। যেমন : আসামীদেরকে আদালতে হাজির করা, জব্দকৃত আলামত প্রমাণস্বরূপ আদালতে উপস্থাপন করা সহ বিভিন্ন কাজ করে থাকে। এমনি একজন পুলিশ কনস্টেবল পিন্টু, যিনি সুনামগঞ্জ আদালতে কর্তব্যরত ছিলেন।
“লইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম” কর্তৃক প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায়, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৩য় আদালতে তখন সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালীন সময়ে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ হেলাল উদ্দিন জিআর ৬৭/১৯ইং (সদর) মোকদ্দমার জব্দকৃত আলামত উপস্থাপন করার জন্য কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য পিন্টুকে নির্দেশ প্রদান করায় কনস্টেবল পিন্টু কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেন। পরে মালখানা থেকে আলামত নিয়ে এসে এজলাস কক্ষে বিচারকের সামনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করায় আদালত ওই পুলিশ সদস্যকে কাঠগড়ায় আটক রাখার আদেশ দিলে আদালত পাড়ায় আবস্থানরত সকল পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং খবর পেয়ে পাশ্ববর্তী থানা ও শহর থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা কনষ্টেবল এসে জড়ো হয়।
অভিযোগ আছে যে সেই পুলিশ বিচারকের নাম ধরে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজও করেছেন। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখে এজলাস কক্ষের সকল দরজা বন্ধ করে চলে বিচার কার্যক্রম। পুলিশের এই অস্বাভাবিক আচরণের প্রতিবাদ করলে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের সাথেও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে পুলিশরা। এসময় উপস্থিত আইনজীবী ও সাংবাদিকগণ তাদেরকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে ও ঘটনার ছবি তুলতে চাইলে আইনজীবী সাংবাদিক চ্যানেল ২৪ এর প্রতিনিধি এআর জুয়েল, যমুনা টেলিভিশনের প্রতিনিধি আমিনুল ইসলামের ক্যামেরা মোবাইল ফোন জোর পূর্বক ছিনিয়ে নেয়া বলে অভিযোগ আছে।
যদিও ঘটনার পরে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সাঈদকে প্রধান করে ২ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা পুলিশ এবং ৪ পুলিশকে প্রত্যাহার করা হয়। প্রত্যাহার করা ৪ পুলিশ সদস্য হলেন- এএসআই লুৎফুর রহমান, কন্সটেবল মুস্তাক, পিন্টু ও রহমান।
প্রশ্ন হচ্ছে সুনামগঞ্জের আদালতে পুলিশের এমন ভূমিকা কিসের আলামত এবং এমন অপরাধের কি বিচার আশা করা যায়? বিচারের কথা চিন্তা করার আগে পটভূমিটা একটু পরিস্কার হওয়া দরকার। “লইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম” কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদের তথ্য মতে পাশ্ববর্তী থানা ও শহর থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এসে জড়ো হয় এই সমাবেশে। প্রশ্ন হচ্ছে পাশ্ববর্তী থানা ও শহর থেকে যারা এসে এই সমাবেশে যোগ দেন তারা কি ওই সময় যার যার কর্মস্থলে কর্তব্যরত ছিলেন এবং নিজের দায়িত্বকে উপেক্ষা করে সমাবেশে যোগ দেন? যদি বিষয়টা এমন হয় তবে এটা রাষ্ট্রের জন্য একটি অশুভ সংকেত। আজকে এরা নিজের দায়িত্বকে উপেক্ষা করে আদালতে সমাবেশ করেছে, কাল করবে রাস্তায়, এবং পরশু সংসদ ভবনে।
যদিও জেলা পুলিশ বলছে যে তদন্ত শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে, কিন্তু সেটা হবে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত এবং তাদের গতানুগতিক শাস্তি বলতে আমরা যা দেখি তা হচ্ছে সাময়িক বরখাস্ত অথবা অন্য জেলায় বদলি অথবা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে স্থানান্তর। কথা হচ্ছে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত শেষে যদি এইরূপ শাস্তি দেয়া হয় তবে কি তা যথার্থ হবে কিনা, এবং পুলিশের তদন্তের পাশাপাশি বিচারবিভাগীয় তদন্তের দরকার আছে কিনা।
পুলিশের বেআইনী কর্মকাণ্ড বা ক্ষমতার বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নজির আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়৷ অপরাধের ধরণ পরিমাপ করে আদালত এই দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণসহ অন্যান্য শাস্তির আদেশ দিয়ে থাকেন৷
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অন্যতম অংশ হওয়ার ফলে আদালত পুলিশের দায়িত্ব পালনের ধরণ, ক্ষমতার বাড়াবাড়ি কিংবা আইনকে বেআইনীভাবে প্রয়োগ করে নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি বরদাস্ত করতে পারে না৷ যেহেতু সুনামগঞ্জের ঘটনাটি ঘটেছে আদালতের ভেতরে সেহেতু এ ব্যাপারে আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত ভূমিকা অবশ্যই কাম্য৷ কেননা, আদালতের ভূমিকা পুলিশকে অধিকতর পেশাদার হতে শুধু বাধ্যই করবে না, প্রেরণাও যোগাবে বলে আমার ধারণা।
লেখক : পিএইচডি গবেষক; আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, হংকং।