ব্যারিস্টার পল্লব আচার্য : হিন্দু আইনের মূল বিষয়টি আসে আমাদের পবিত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে ও বিভিন্ন মুনি ঋষি থেকে। সেই প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু তথা সনাতনীদের সম্পত্তি বন্টন, জীবনযাত্রার নিয়ম এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা এই রীতি অনুযায়ী কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে পারিবারিক কোন্দল ও সামাজিক বিরোধ কম দেখা দেয়।
বর্তমান সময়ে আধুনিক যুগে দেখা যায় বিবাহ বিচ্ছেদের মত ঘটনা অহরহ ঘটে যাচ্ছে। সনাতনীরা বিশ্বাস করে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে ভগবানের হাতে তাই এখানে বিচ্ছেদের বিষয়টা দেখার কোন সুযোগ নেই। অপরদিকে একজন সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী হিসেবে অনেক সনাতনী নারীরা এসে তার স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ দেন এবং বিচ্ছেদের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিকদেশ এবং বাংলাদেশের কোন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন হলে তা আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। যদি কোন স্বামী বা স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হবে। আর বিচ্ছেদের বিষয়ে বলতে গেলে একজন আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া তা কার্যকর করা সঠিক হবেনা।
হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মারা যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে (অর্থাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যায়), ক্লীব (পুরুষত্বহীন) হয় অথবা পতিত (ধর্ম বা সমাজ থেকে বিচ্যুত) হয় – এই পাঁচ প্রকার বিপদের ক্ষেত্রে নারীকে অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বিধেয়। কিন্তু পরিবর্তনশীল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আইনকেও পরিবর্তন হতে হয় তাই হিন্দুদের মূলধারা ঠিক রেখে আইনকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যেমন Literal Rule এ যদি Justice দেওয়া না যায় তাহলে Golden Rule বা Mischief Rule ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে হিন্দুদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার অনেকাংশই কম তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ধর্মীয় রীতিনীতির উপর বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধাবোধ। হিন্দু প্রতিটি সংসার এর মূল হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসন ও পরম্পরা। সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় নারীদেরকে যখন বিবাহ দেওয়া হয় তখন তার বংশ, গোত্র, কুল, বর্ণ সব পরিবর্তন হয়ে যায় তাই হিন্দু বিবাহের ক্ষেত্রে কনের পিতা-মাতা বিবাহের সময় কনেকে উপযুক্ত সম্মান ও সামর্থ্য দিয়ে বিবাহ দিয়ে থাকেন। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটি আসলে সরাসরি কোনো আইন থেকে নয় বরং ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম থেকে নিয়ে করা হয়েছে।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সবচেয়ে সহজ বিষয়টি হচ্ছে ৫৩ জনের একটি লিস্ট দেওয়া আছে এবং সেটি একটি ক্রম অনুসারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিবাহকালীন সময়ে যদি সচেতন পিতা-মাতা তার কন্যাকে তার প্রাপ্য তাকে বুঝিয়ে দেয় তাহলে পিতামাতার অবর্তমানে ভাই-বোনের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে এবং আদালতে মামলা মোকদ্দমায় জড়াতে হবেনা। এতে করে যেমন আদালতের মূল্যবান সময় বাঁচবে এবং অটুট থাকবে ভাই-বোনের সম্পর্ক। প্রচলিত হিন্দু আইনে এটি স্পষ্ট বলা আছে যে সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকার থাকবে তা স্ত্রীধনের উপর এবং পিতা-মাতা কর্তৃক প্রদত্ত সম্পত্তি কন্যা নিজে ইচ্ছেমত স্থানান্তর ও ভোগ করতে পারবে।
অন্যদিকে The Hindu Women’s Right to Property Act, 1973 হিন্দু বিধবা নারীদের অংশ সুনির্দিষ্ট করা হয় যা এক পুত্রের সমান অংশ। তবে বলা হয়ে থাকে এটা জীবনস্বত্ব কিন্তু আদালতের শরণাপন্ন হয়ে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে বিক্রয় করতে পারে। এ বিষয়টাকে সহজলভ্য করে একটা নীতিমালা করে দিলে তাহলে বিধবা নারীদের স্বামীর সম্পত্তি হস্তান্তর এর অধিকার প্রয়োগ করতে সহজ হবে।
আর কোন অবস্থাতে যদি হিন্দু নারী বা পুরুষ ধর্মান্তরিত হয় তাহলে হিন্দু ধর্মের প্রচলিত নীতি অনুযায়ী সে সকল সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। The Freedom of Religion Act আইনটি The Bangladesh Laws (revision and declaration) Act 1973 ধারা বাতিল হয়েছে। তাই ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে সম্পত্তি দাবি করার কোন অধিকার থাকে না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি এখন সময় এসেছে হিন্দু আইনের মূলধারা ঠিক রেখে আইনের অস্পষ্ট এবং অকার্যকর বিষয়গুলো স্পষ্ট আকারে প্রণয়ন করা যাতে আইনটি শক্তিশালী এবং যুগোপযোগী হয়ে উঠে। এতে করে একদিকে যেমন সুবিধাবঞ্চিত, নির্যাতিত নারীরা তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে অন্যদিকে হিন্দু সমাজে পূর্বের ন্যায় প্রশান্তি বজায় থাকবে।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।