দেশের বহুল আলোচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলার দুই আসামিকে একই মঞ্চে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) রাত ১০টা ১ মিনিটে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রায় কার্যকর করা হয়।
মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুই আসামি হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং ড. তাহেরের বাড়ির কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম।
রায় কার্যকরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিনিয়র জেল সুপার আবদুল জলিল। তিনি বলেন, ‘হত্যা মামলার দুই আসামি অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের পর মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হবে। পরে কারাবিধি মেনে মরদেহ দুই পরিবারের কাছে হস্তান্তর হবে।’
ফাঁসির রায় কার্যকরের সময় উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ, রাজশাহী জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র যে সুপার আব্দুল জলিল, জেলার নিজামুদ্দিন।
এছাড়াও কারা কর্তৃপক্ষ আট জনের দুটি মেডিকেল টিম তৈরি করেছিল। যার একটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ডা. মিজান উদ্দিন, আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন ডা. জোবায়ের আহমেদ।
এর আগে, রাত নয়টার দিকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের পেছন ফটক দিয়ে প্রশাসনের চারটি গাড়ি প্রবেশ করে।
ফাঁসি কার্যকরে প্রস্তুতি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলার দুই আসামির ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।
কারাগারের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় কারাগারের পূর্ব দিকের দেয়ালের পাশে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুতের কাজ শুরু হয় এক সপ্তাহ আগেই। নিয়ম অনুযায়ী জল্লাদ টিম গঠন করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে আট জল্লাদের ওই টিম একাধিকবার মহড়াও দিয়েছে।
আরও পড়ুন: ড. তাহের হত্যা : আপিল খারিজ, ফাঁসি কার্যকরে বাধা নেই
এই জল্লাদরাই নির্ধারিত সময়ে আসামিদের ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান, পরিয়ে দেন কালো টুপি ও ফাঁসির দড়ি। সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে দলের প্রধান জল্লাদ একজন সহযোগীকে নিয়ে ফাঁসি কার্যকর করেন।
নিয়ম অনুযায়ী, ফাঁসি কার্যকরের পর ৩০ মিনিট লাশ দড়িতে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। পরে ময়নাতদন্ত সেরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় মরদেহ।
রাত ১০টায় ফাঁসি কার্যকর হলে ৯টার দিকে দুই আসামিকে বিষয়টি জানানো হয়। এরপর তাদের গোসল করিয়ে শেষ ইচ্ছা জানতে চাওয়া হয়। কারা মসজিদের ইমাম তাদের তওবা পড়ান।
ডিআইজি প্রিজনস, সিনিয়র জেল সুপার ও জেলার ছাড়াও জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি, সিভিল সার্জন, মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন ফাঁসি কার্যকরের সময়। কারাগারে প্রস্তুত রাখা হয় লাশ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স।
দুই আসামির পরিবারের সদস্যরা গত মঙ্গলবার তাদের সঙ্গে শেষ দেখা করেছেন। সেদিন জাহাঙ্গীরের পরিবারের ৩৫ সদস্য এবং মহিউদ্দিনের পরিবারের তিন সদস্য রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করেন।
মামলার প্রেক্ষাপট
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পশ্চিমপাড়া আবাসিক কোয়ার্টার থেকে অধ্যাপক তাহের নিখোঁজ হন। ওই বাসায় তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর তার দেখাশোনা করতেন।
পরদিন বাসার পেছনের ম্যানহোল থেকে অধ্যাপক তাহেরের গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
অধ্যাপক তাহেরের করা একটি জিডির সূত্র ধরে বিভাগের শিক্ষক মহিউদ্দিন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীরসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারদের মধ্যে তিনজন আদালতে জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধ্যাপক এস তাহের বিভাগের একাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু গবেষণা জালিয়াতির কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মহিউদ্দিন হত্যার পরিকল্পনা করেন।
বালিশ চাপা দিয়ে খুনের পর বাড়ির ভেতরে থাকা চটের বস্তায় ভরে অধ্যাপক তাহেরের লাশ বাসার পেছনে নেওয়া হয়। লাশ গুমের জন্য জাহাঙ্গীররের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আবদুস সালামকে ডেকে আনা হয়। তাদের সহায়তায় বাসার পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে তাহেরের লাশ ফেলে দেওয়া হয়।
বিচার ও রায়
২০০৭ সালের ১৭ মার্চ শিবির নেতা মাহবুব আলম সালেহীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসি ও দুজনকে খালাস দেয়।
দণ্ডিত অন্যরা হলেন জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল ও তার স্ত্রীর ভাই সালাম। তবে ছাত্রশিবিরের নেতা সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সি বিচারে খালাস পান।
পরে দণ্ডিতরা হাই কোর্টে আপিল করেন। হাই কোর্ট মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের রায় বহাল রাখলেও নাজমুল ও সালামের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
আরও পড়ুন: ড. তাহের হত্যাকাণ্ড নজিরবিহীন মহাঅপরাধ : আপিল বিভাগ
পরে তাদের দণ্ড বৃদ্ধি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাই কোর্ট বিভাগের রায়ই বহাল রাখে। এরপর আসামিদের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনও খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট।
শেষ ধাপে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন আসামিরা। ছয় মাস আগে রাষ্ট্রপতি সে আবেদনও নাকচ করে দিলে দণ্ড কার্যকরের সব বাধা কাটে।