দেশের আদালতসমূহে চলমান দুর্নীতির মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে যত দ্রুত সম্ভব নিজস্ব স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট গঠনের উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
আজ শনিবার (৯ ডিসেম্বর) বেলা ১১টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটরিয়ামে ‘দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ অনুরোধ জানান। অনুষ্ঠানে দেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তির বিকাশের কারণে দুর্নীতির ধরণ ও পদ্ধতি পাল্টেছে। তাই বর্তমান বাস্তবতায় দুদকের সামনে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ বিরাজমান। এ কারণে দুদককে দুর্নীতি দমন, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে শুধু গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় মামলা-মোকদ্দমা নয়, বরং আন্ডারকভার অপারেশন, সার্ভিলেন্স, কোভার্ট ইনভেস্টিগেশন, মামলা পরিচালনায় আধুনিকীকরণ, রেকর্ড ব্যবস্থাপনা যুগোপযোগীকরণ, পুনরুদ্ধার করা সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ, দুর্নীতি প্রতিরোধে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনীমূলক কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, অনেকক্ষেত্রেই দুর্নীতি ও দুর্নীতিলব্ধ অর্থ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে পাচার হয়, ফলে জন্ম নেয় আন্তরাষ্ট্রীয় অপরাধ। এ ধরণের অপরাধ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেশন অ্যাগেইনস্ট করাপশন (আনকাক) -এ স্বাক্ষরকারী দেশ হয়েছে। এছাড়া বিদেশি রাষ্ট্র থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও দুর্নীতিলব্ধ অর্থ পুনরুদ্ধার এবং এতদবিষয়ে আন্তরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা গ্রহণ ও প্রদানের জন্য ইতোমধ্যে ‘অপরাধ সম্পর্কিত পারষ্পরিক সহায়তা আইন-২০১২’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, দুর্নীতির মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দেশের সকল জেলায় বিশেষ জজ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়া, বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক বেঞ্চ দুর্নীতি দমন আইন ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলাসমূহ শুনানি করছেন। তাই দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি যে দেশের অধস্তন আদালত ও উচ্চ আদালতে দুর্নীতির মামলাসমূহ যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তির জন্য বিচার বিভাগ সচেষ্ট রয়েছে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি বৈষম্য, সামাজিক অনৈক্য এবং অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করে, তেমনি তা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করে। তাই আমি মনে করি, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের গুরুদায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনের হলেও এককভাবে কমিশনের পক্ষে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং আইন বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও জনগণের সক্রিয় উদ্যোগই পারে সমাজ থেকে দুর্নীতি নামক বিষবৃক্ষ নির্মূল করতে। আমরা সেই জাতি যারা অন্যায়-অবিচার, দুঃশাসন-অপশাসন, বৈষম্য-জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করেছি। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও লড়াই করেও জয়লাভ করতে পারবো, ইনশাআল্লাহ্। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান থাকবে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ধারণ করে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ করে দুর্নীতিবাজদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করুন।
ওবায়দুল হাসান বলেন, এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক যে, দুদক কর্তৃক মামলা দায়ের যেমন পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি মামলায় সাজার হারও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে আমি জেনেছি যে বিগত ২০২২ সালে বিশেষ জজ আদালতে নিষ্পত্তিকৃত ৩৪৬টি মামলার মধ্যে ২১১টি মামলাতেই সাজা প্রদান করা হয়েছে। দেশের সার্বিক ফৌজদারি মামলার সাজার হার বিবেচনায় নিলে এটি প্রশংসার দাবীদার।
তিন আরও বলেন, কমিশনের তদন্তকারী কর্মকর্তাগোন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তদন্ত কার্য সম্পন্ন করে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে সক্কগম হয়েছেন বিধায়ই এটি সম্ভব হয়েছে। এজন্য আমি কমিশনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।
স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিদ্যমান আইনে স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিটের মাধ্যমে আদালতে মামলা পরিচালনার বিধান রয়েছে। তাই দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে আপনারা যত দ্রুত সম্ভব নিজস্ব স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। তাহলে দেশের আদালতসমূহে চলমান দুর্নীতির মামলাসমূহ আরও দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।
একই সাথে কমিশনের অনুসন্ধান, তদন্ত ও তদারকির কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের প্রতিয়ামার অনুরোধ থাকবে আপনারা সর্বোচ্চ সততার সাথে আপনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন। অনুসন্ধান ও তদন্তকালে আইন দ্বারা অর্পিত দায়িত্ব দৃঢ়তার সাথে পালন করবেন। তদন্তকালে কার্যক্রম তত্ত্বাবধায়নকারীগণের প্রতি অনুরোধ থাকবে আপনারা প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদন যথাযথভাবে পর্যালোচনা করবেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ সন্নিবেশিত হয়েছে কি না সে বিষয়ে পরীক্ষা করবেন এবং যতটা নির্ভুল তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করবেন, যোগ করেন তিনি।
প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের সকলের প্রতি আহ্বান থাকবে অত্যন্ত নির্মোহভাবে, কোন অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে, নিষ্ঠার সাথে সুষ্ঠুভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবেন। আপনার কোন ভুল পদক্ষেপে যেন কোন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকবেন।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ ২০০৩ সালে এ দিনকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ঘোষণা করে। সে হিসেবে এবার ২১তম আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ।