সিরাজ প্রামাণিক: ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ইতোমধ্যে বলেই ফেলেছেন যে তিনি কোন পদত্যাগপত্র পাননি। সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপকালে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, তিনি শুনেছেন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে তার কাছে এর কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।
বেশ কিছুদিন আগেও একটি কথা চাওর হয়ে উঠেছিল যে, বহু বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাযথ প্রক্রিয়ায় পদত্যাগ না করায় তিনি এখনও প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা’র একটি ফোন কলের অডিও প্রকাশ পেয়েছে। আরেকটি ভিডিও কলে শেখ হাসিনা বলছেন, ‘‘আমি দেশের কাছাকাছি আছি, যাতে চট করে ঢুকে যেতে পারি’’।
শেখ হাসিনা কি আদৌ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, প্রশ্ন তুলেছেন রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার। এর আগে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী! আপনারা কেউ শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র দেখেছেন?
এরই মধ্যে আবার নতুন করে বিতর্ক। মানব জমিন এর ‘জনতার চোখ’ এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আমি বহুবার পদত্যাগপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। হয়ত তার সময় হয়নি। ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বঙ্গভবনে ফোন আসে, যেখানে বলা হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসবেন। এরপরই বঙ্গভবনে প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি ফোন আসে যে তিনি (শেখ হাসিনা) আসছেন না। ’
তিনি বলেন, ‘চারদিকে অস্থিরতার খবর। কী হতে যাচ্ছে জানি না। আমি তো গুজবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না। তাই সামরিক সচিব জেনারেল আদিলকে বললাম খোঁজ নিতে। তার কাছেও কোনো খবর নেই। আমরা অপেক্ষা করছি। টেলিভিশনের স্ক্রলও দেখছি। কোথাও কোনো খবর নেই। এক পর্যায়ে শুনলাম, তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাকে কিছুই বলে গেলেন না। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কি—না? একই জবাব। শুনেছি, তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় তিনি সময় পাননি জানানোর। ’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সব কিছু যখন নিয়ন্ত্রণে এলো, তখন একদিন মন্ত্রিপরিষদসচিব এলেন পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে। তাকে বললাম, আমিও খুঁজছি।
স্ব স্ব ধর্মের পবিত্র গ্রন্থের মতো সত্য যে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। এরপর তিনি ভারতে পালিয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার—উজ—জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর জানান। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা নিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে যে মুখরোচক গল্পের আবির্ভাব ঘটেছে এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন ও উত্তর জানতে আমার আইনাঙ্গনের অনেক শুভাকাঙ্খী ফোন করছেন। অবশেষ এ লেখা দিয়ে বিতর্কিত বিষয়ে আইনগত সমাধানের দিকে যেতে চাই। আইনের শিক্ষার্থী ও পেশাগত কাজে বাংলাদেশের সংবিধান নিয়মিত চর্চা করতে হয়। সহজ ভাষায় আমাদের সংবিধান রচিত। বোঝার জন্য খুব বেশী লেখাপড়া জানার দরকার নেই। বাংলা পড়তে পারেন—এমন মানুষ বোধ হয় সহজ এ বিষয়টি বুঝতে পারবেন।
আমাদের সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা আছে। কী আছে দেখুন-
৫৭। (১) প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি—
(ক) তিনি কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন; অথবা
(খ) তিনি সংসদ—সদস্য না থাকেন।
(২) সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন কিংবা সংসদ ভাংগিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শদান করিলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোন সংসদ—সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নহেন এই মর্মে সন্তুষ্ট হইলে, সংসদ ভাংগিয়া দিবেন।
(৩) প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।
সম্মানীত পাঠক একটু খেয়াল করুন। কিন্তু দেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী পলায়ন করলে কিংবা পালিয়ে যেতে বাধ্য হলে কি হবে, সে বিষয়ে এখানে কিছুই বলা নেই। এক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ। দেখুন কী আছে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ।
১০৬। যদি কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এইরূপ কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপীল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানীর পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।
এজন্যই রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টের উপদেশমূলক মতামতের ভিত্তিতে ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করেছেন। উড়পঃৎরহব ড়ভ হবপবংংরঃু (সময়ের চাহিদা নীতি) বিষয়ে যাদের আইনী জ্ঞান আছে তাঁরা বিষয়টি ভালভাবে বুঝতে পারছেন।
কাজেই রাষ্ট্রপতি যে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার এবং এটা হচ্ছে ওনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল। এই পদে থাকার তিনি রীতিরকম যোগ্যতা হারিয়েছেন। কারণ গত ৫ আগস্টে রাস্ট্রপতির ভাষণ, পুরো জাতির কাছে বিভিন্নভাবে বার বার নিশ্চিত করেছেন এবং সুনিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দিয়েছেন এবং তিনি তা নিয়েছেন।
আজ যদি প্রায় আড়াই মাস পর তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দেননি, তাহলে এটি এক ধরনের স্ব—বিরোধিতা হয়, শপথ লঙ্ঘন হয় এবং তার এ পদে থাকার যোগ্যতা আছে কি না, সে বিষয় বাংলার ১৮ কোটি মানুষ ভেবে দেখবেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি যদি শারীরিক মানসিক সক্ষমতা না থাকে বা তিনি যদি গুরুতর অসদাচরণ করেন, তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে থাকতে পারবেন না। এখানে স্ব—বিরোধী কথাবার্তা বলার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপতির এমন মন্তব্যে পতিত ফ্যাসিস্ট মাথা চাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আয়োজন করছে না তো? ভেবে দেখার সময় কিন্তু এখনই।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগবেষক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা।