অ্যাডভোকেট আল মুস্তাসিম নবী নিকু : গত ১ জুলাই ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশ সরকার ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’-এর অধিকতর সংশোধনকল্পে একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। সংশোধিত আইনে বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়ন, মামলাজট নিরসন এবং সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকারের প্রসারকে মূল লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই পদক্ষেপ নিয়ে ইতোমধ্যে আইনজীবী সমাজ, মানবাধিকারকর্মী এবং সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
ইতিবাচক দিক
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ বৃদ্ধি
সংশোধনী অনুযায়ী, এখন থেকে পারিবারিক আদালতের মামলা, পাঁচ লাখ টাকার কম মূল্যের চেক ডিজঅনার মামলা, যৌতুক প্রতিরোধ আইনের ৩ ও ৪ ধারার মামলা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারার মামলা আদালতে দায়েরের আগে বাধ্যতামূলকভাবে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (Alternative Dispute Resolution – ADR) করতে হবে।
শান্তিপূর্ণ পারিবারিক সমাধান
তালাক, যৌতুকসংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝি কিংবা পারস্পরিক মনোমালিন্যের মতো অনেক পারিবারিক সংকট আদালতের বাইরে সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। এতে সামাজিক বন্ধন রক্ষা পাবে এবং অপ্রয়োজনীয় মামলা কমে যাবে।
মামলাজট নিরসনে কার্যকর অবদান
প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি বিচারাধীন মামলার ভারে নত বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থা কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। ADR বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনেক মামলা আর আদালতের দরজায় পৌঁছাবে না, ফলে বিচার প্রক্রিয়ার গতি বাড়বে।
দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের জন্য Access to Justice
আইনি ব্যয় এবং জটিলতার কারণে বহু দরিদ্র মানুষ আদালতে যেতে পারেন না। লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে তাদের জন্য বিনা খরচে আইনি সহায়তা এবং মধ্যস্থতার সুযোগ তৈরি হবে, যা আইন প্রাপ্তির পথ উন্মুক্ত করবে।
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্কৃতির প্রসার
এটা বাংলাদেশের আইনি সংস্কৃতিতে নতুন এক ধারা তৈরি করতে পারে। ছোটখাটো পারিবারিক ও আর্থিক বিরোধগুলো মামলা ছাড়াই মীমাংসার সুযোগ পাবে।
উদ্বেগের দিক
ফৌজদারি মামলায় বাধ্যতামূলক ADR: এক প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত
যৌতুক প্রতিরোধ আইনের ৩ ও ৪ ধারা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারা—সবকটি ফৌজদারি অপরাধ। এসব মামলায় ভিকটিমের নিরাপত্তা, সম্মান ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করে বাধ্যতামূলক ADR চাপিয়ে দেওয়া গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।অভিযুক্তরা প্রভাব খাটিয়ে ভিকটিমকে আপস করতে বাধ্য করতে পারে।
চেকডিজঅনার মামলায় প্রতিকার বিলম্ব
৫ লাখ টাকার কম মূল্যের চেক ডিজঅনার মামলা ও এখন বাধ্যতামূলক ADR-এর আওতায় পড়েছে। এটি ফৌজদারি আর্থিক প্রতারণা মামলা। এ ধরনের মামলায় ভুক্তভোগীকে প্রথমেই দীর্ঘ মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে বাধ্য করলে প্রতিকার পাওয়ার সময়কাল অনর্থক দীর্ঘতর হতে পারে। অনেক সময় প্রতারকরা এটিকে একটি বিলম্ব কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে।
প্রভাবশালীদের কর্তৃত্বের ঝুঁকি
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় ADR প্রক্রিয়া সর্বদা নিরাপদ এবং নিরপেক্ষ হবে—এমন নিশ্চয়তা নেই। প্রভাবশালীরা কিংবা অভিযুক্তপক্ষ ভিকটিমের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে গ্রামীণ এবং প্রান্তিক জনগণের জন্য এই ঝুঁকি অনেক বেশি।
ভিকটিমের সম্মতি ছাড়া ADR: ন্যায়বিচারের পরিপন্থী
ফৌজদারি কোনো মামলায় ভিকটিমের স্পষ্ট সম্মতি ছাড়া ADR বাধ্যতামূলক করা হলে তা ন্যায়বিচারের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াবে। এতে ভিকটিমের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে।
উপসংহার
লিগ্যাল এইড আইন সংশোধন নিঃসন্দেহে দেশের বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং মামলাজট নিরসনে এক যুগান্তকারী প্রচেষ্টা। পারিবারিক বিরোধ বা ছোটখাটো আর্থিক বিষয়ে এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে—এতে সন্দেহ নেই।
তবে অপরাধমূলক মামলা, বিশেষ করে নারী নির্যাতন কিংবা আর্থিক প্রতারণার মামলায় বাধ্যতামূলক ADR ভিকটিমের অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে পারে এবং অপরাধীদের পক্ষে আইনি ফাঁক তৈরি করতে পারে।
তাই সংশোধিত আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য জরুরি—একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবমুখী এবং মানবাধিকার সংবেদনশীল নীতিমালা। কোন কোন মামলা ADR উপযোগী এবং কোনগুলো নয়, তা নির্ধারণে স্বচ্ছ নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভিকটিমের সম্মতি ছাড়া কোনও ফৌজদারি মামলায় ADR চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। একইসঙ্গে প্রতিটি ADR সেশনে ভিকটিমের নিরাপত্তা, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার এবং নিরপেক্ষ তা নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি লক্ষ্য একটাই ‘ন্যায়বিচার সহজলভ্য হোক, তবে যেন তা বিলম্বিত, ভীতিকর বা ভিকটিম-বান্ধবহীন না হয়।’
লেখক : আইনজীবী, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট। ই-মেইল: almustashimnobi.niku@gmail.com