বর্তমানে একটি আলোচিত বিষয় হলো—হাইকোর্ট কি প্রতিটি বিভাগে স্থানান্তরিত হবে?
বাংলাদেশ সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী:
রাজধানীতে সুপ্রীম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকিবে, তবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লইয়া প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে অন্য যে স্থান বা স্থানসমূহ নির্ধারণ করিবেন, সেই স্থান বা স্থানসমূহে হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইতে পারিবে।
এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। অতীতে এই বিধান থাকলেও স্থায়ীভাবে বিভাগীয় হাইকোর্ট কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি, যদিও চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় অস্থায়ী সার্কিট বেঞ্চ বসেছে।
স্থানান্তরের পক্ষে মত দিচ্ছেন অনেকেই, বিশেষ করে বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে। এটা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক আমাদের নীতি নির্ধারকগণ বিচারপ্রার্থীদের ব্যাপারে ভাবছেন, তবে এই সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য জটিলতা, কাঠামোগত সমস্যা ও হাইকোর্টের ভাব-গাম্ভীর্য ক্ষয়ের বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
আসলেই কি জনকল্যাণ হবে?
প্রতি বিভাগে হাইকোর্ট বেঞ্চ বসালে আদালত হয়তো বিচারপ্রার্থীর কাছে আসবে, কিন্তু ন্যায়বিচার কি সত্যিই কাছাকাছি পৌঁছাবে?
প্রথমত, বিভাগীয় বেঞ্চ হলে তার এখতিয়ার কী হবে—সিভিল, ক্রিমিনাল, নাকি রিট? যদি সবই হয়, তবে এত সংখ্যক বিচারক কোথা থেকে আসবে? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, হাইকোর্ট বিভাগেই বিচারক স্বল্পতা রয়েছে। নতুন নিয়োগ দিয়ে যদি পূরণ করাও হয়, তবে তারা কি বিচ্ছিন্ন অবস্থানে থেকে হাইকোর্টের প্রতিষ্ঠিত রীতি ও গাম্ভীর্য রক্ষা করতে পারবেন?
তদুপরি, মামলার নথি ঢাকা থেকে বিভাগে স্থানান্তর, দূরবর্তী বিভাগে আইনজীবীদের যাতায়াত, এবং নতুন আইনজীবীদের হাইকোর্ট পর্যায়ের অভিজ্ঞতা না থাকা—এসবই বিচারপ্রক্রিয়াকে জটিল করবে। হাইকোর্টে মামলা পরিচালনার জন্য ‘হাইকোর্ট পারমিশন’ থাকা বাধ্যতামূলক, যা নিম্ন আদালতে অনেকের নেই। যাদের আছে তারা বেশিরভাগে হাইকোর্টে প্র্যাক্টিস করেন না। অতএব, দক্ষ আইনজীবীর অভাব বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বাড়াতে পারে।
বিকল্প কি নেই?
হাইকোর্টে মূলত আপিল ও রিভিশন হয়—অর্থাৎ কাগজপত্রভিত্তিক বিচার। সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ইত্যাদি ব্যতিক্রমী ঘটনা। পক্ষদের সরাসরি হাজিরা লাগেও না। অধিকাংশ কাজই আইনজীবীরা সম্পন্ন করেন।
এই প্রেক্ষাপটে অনলাইন ফাইলিং, ভিডিও শুনানি, ডিজিটাল প্রোফাইল, এবং ই-অর্ডার সিস্টেম—এসব প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সেবা দ্রুততর ও সহজ হতো। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও পক্ষরা হাইকোর্টে যুক্ত হতে পারতেন। আইনজীবীদের অনলাইন প্রোফাইল তৈরি থাকলে পক্ষরা সহজেই অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আইনজীবী নির্বাচন করতে পারতেন—দালালের দৌরাত্ম্যও কমে যেত।
হাইকর্টের বিজয় ৭১ ভবনসহ সহ কিছু ভবনে টয়লেটের অবস্থা এত নাজুক যে সেখানে গেলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে এদেশে এত জনকল্যাণকামী নীতি নির্ধারক আছেন। বলাই প্রয়োজন, ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট ভবনেই এখনও অনেক সমস্যার সমাধান হয়নি—বিশেষত টয়লেট ও বসার জায়গার মতো প্রাথমিক সুবিধা। বিচারক সংখ্যা বাড়ানো বা ডিজিটাল কাঠামো উন্নয়নের বদলে বিভাগে নতুন কোর্ট গড়া, অনেকটাই বাহ্যিক সমাধানের মতো শোনায়।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দিল্লিতে একটিই, তবে প্রতিটি রাজ্যে হাইকোর্ট রয়েছে এবং কিছু রাজ্যে বেঞ্চও আছে। পাকিস্তানেও লাহোর হাইকোর্টের অধীন বিভিন্ন বেঞ্চ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টও এককেন্দ্রিক; তবে তারা “Circuit Courts” এর মাধ্যমে অঞ্চল ভাগ করেছে।
তবে সবক্ষেত্রেই উচ্চ আদালত এককেন্দ্রিক ও সুসংগঠিত কাঠামোর মধ্যেই কাজ করে। যা মূলত ন্যায়বিচারের মান নিশ্চিত করার জন্য জরুরি।
ভুল পথে জনকল্যাণ?
বিভাগীয় হাইকোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য যেহেতু আপিল বিভাগে আসতেই হবে, তাহলে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কাঠামো থেকেই বিচারের পথ থেকে যাবে অপরিবর্তিত।
এর বদলে যদি হাইকোর্টকে জনবল ও প্রযুক্তি-নির্ভর কাঠামোয় শক্তিশালী করা হতো, তবে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ সত্যিই কমানো যেত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা হলেও বিচারকের অভাবে বহু মামলা ঝুলে ছিল বহু বছর। সাইবার ট্রাইব্যুনালও এখনো সব জেলায় গঠিত হয়নি।
উপসংহার
যথাযথ সমীক্ষা, মানবসম্পদ ও কাঠামো বিশ্লেষণ ছাড়া বিভাগে হাইকোর্ট স্থানান্তর, বাস্তবে জনগণের উপকারের চেয়ে বিভ্রান্তি বেশি তৈরি করবে। বরং প্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে সেটিই হতো প্রকৃত জনকল্যাণ।
লেখক : নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক।