প্রথম অভিজ্ঞতা: আদালতের মাঝখানে অপমান
২০১৬ সালের শেষদিকের এক দিন। বিকেল তিনটার দিকে আমার সিনিয়রের নির্দেশে আমি চট্টগ্রামের একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যাই, একটি মামলায় সাক্ষীর জবানবন্দি নোট করতে। নিয়ম মেনে পিয়নকে ‘খুশি’ করে নথি সংগ্রহ করে কাজ শুরু করি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আদালতের পেশকার আমার দিকে চোখ তুলে বললেন, “নথি ফেরত দিন!” আমি বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করলাম—“দয়া করে আমাকে কাজটা শেষ করতে দিন। প্রয়োজনে আপনাকেও খুশি করবো।”
আমি নিজের কাজটা শেষ করতে দৃঢ় ছিলাম, কিন্তু তিনি আমার কোনো কথায় কর্ণপাত না করে অত্যন্ত অসৌজন্যমূলকভাবে আমার হাত থেকে নথিটি ছিনিয়ে নেন। যেন আমি কেউ না, যেন আমার কোনো অবস্থান, কোনো সম্মান নেই। ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন পাঁচ থেকে সাতজন আইনজীবী। আমি অপমানে কাঁপতে কাঁপতে তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলেন না—কারণ আমি ছিলাম একজন ‘নন-এনরোল্ড’ শিক্ষানবীশ আইনজীবী।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা: “স্যার” না বলার অপরাধে লাঞ্ছনা
শুধু আদালতের পেশকার নয়, শিক্ষানবীশ জীবনে আরও একটি অপমান আমাকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকে চট্টগ্রাম বারের একজন সিনিয়র আইনজীবী আমার পরিচিত ও রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সেই সূত্রে আমি তাকে ভাই বলেই ডাকতাম।
শিক্ষানবীশ হিসেবে কোর্টে যাত্রা শুরুর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এক অনুষ্ঠানে, তাঁর অনুপস্থিতিতে আলোচনা চলাকালীন সময়ে আমি তাকে “ভাই” বলে উল্লেখ করি।
তখন এক তরুণ আইনজীবী, যিনি তোষামোদে অভ্যস্ত, হঠাৎ করে আমাকে আক্রমণ করে বসেন—”আপনি স্যার না বলে ভাই বললেন কেন?” যেন ‘স্যার’ না বলা মানে গুরুতর অপরাধ। বিষয়টি নিছক তুচ্ছ হলেও, ওই মুহূর্তের অপমান আর লাঞ্ছনার তীব্রতা আমি আজও ভুলতে পারিনি। সবচেয়ে কষ্টের জায়গা ছিল এই যে—একজন শিক্ষানবীশ আইনজীবীর অপমানে কাউকেই বিচলিত হতে দেখা যায় না।
নীরবতা ও নিঃসঙ্গতা: শিক্ষানবীশদের এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা
এই দুই ঘটনার পর আমি বহুজনের কাছে ন্যায়বিচারের জন্য গিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশই বলেছিলেন—“মেনে নাও, এখানকার নিয়ম এটাই। এত আত্মমর্যাদা নিয়ে টিকতে পারবে না।” শুধু একজন বড় ভাই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, যিনি পরদিন গিয়ে ওই পেশকারকে মুখোমুখি করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বারের পাঠাগার সম্পাদক নির্বাচিত হন—যার প্রচারণায় আমি নিরলসভাবে কাজ করেছিলাম। সেই সময়ে অভিযোগ করার প্রক্রিয়া আমার জানা ছিল না। জানলেও, একজন ‘শিক্ষানবীশ ক্রীতদাসের’ দরখাস্ত আদৌ গুরুত্ব পেত কি না, তা নিয়েও আজও সন্দেহ রয়ে গেছে।
আজ বিচারকের আসনে বসে…
আজ আমি একজন বিচারক। কিন্তু যখনই আমার আদালতে কোনো শিক্ষানবীশ আইনজীবী প্রবেশ করে, আমার অতীতের সেই অপমানগুলো স্মৃতিতে ফিরে আসে। চোখে জল এসে পড়ে। আমি জানি, সম্মানের আকাঙ্ক্ষা শুধু অভিজ্ঞদের জন্য নয়—নতুন পথিকের জন্যও তা সমান জরুরি। প্রত্যেক মানুষ, শিক্ষানবীশ হোক বা সিনিয়র, বিচারক হোক বা বিচারপ্রার্থী— সবারই প্রাপ্য ন্যূনতম সম্মান ও মানবিক আচরণ।
লেখক : মো. জুনাইদ; সিনিয়র সহকারী জজ, সুনামগঞ্জ।