ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ
ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ

কিংবদন্তি আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

আজ ১২ জুলাই, বাংলাদেশের ইতিহাসের কিংবদন্তীতুল্য আইনজীবী, জাতির অভিভাবক খ্যাত ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং দেশের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। তাঁর বড় সন্তান ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক

ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ছিলেন সেই বিরল গুটিকয়েক ব্যক্তির একজন, যিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার মাধ্যমে তিনি জাতির অভিভাবক রূপে পরিচিতি লাভ করেন। ইতিহাসখ্যাত মাসদার হোসেন মামলা এবং অষ্টম সংশোধনী মামলা (আনোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ)-এর প্রধান আইনজীবী হিসেবে তার ভূমিকা ছিল যুগান্তকারী।

জন্ম ও পারিবারিক শিকড়

১৯৩২ সালের ১৮ জানুয়ারি, অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের যুক্ত প্রদেশের গাজীপুরে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ। তার পিতা সৈয়দ জাফর আহমেদ ছিলেন দিনাজপুরের হিলির জমিদার ও ব্যবসায়ী। দেশভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন।

জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা জীবনের বিস্তার

প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন হিলির রামনাথ ইংরেজি হাইস্কুলে এবং কলকাতা মাদ্রাসায়। দেশভাগের পরে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা কলেজ থেকে আইএ, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ১৯৫৮ সালে লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে বার-এট-ল এবং লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস থেকে অর্থনীতিতে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

আন্দোলন ও আদর্শের পথে শুরু

ছাত্রজীবনেই ব্রতচারী আন্দোলন ও মুকুল ফৌজের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে আইএনএ-র দুই কর্মকর্তার বিচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেপ্তার হন। ভাষা আন্দোলনের সময় দুইবার এবং ১৯৫৪ সালে তৃতীয়বার কারারুদ্ধ হন। পাকিস্তান সরকারের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্র রাজনীতিতে ছিলেন অন্যতম কণ্ঠস্বর।

আইন পেশায় উজ্জ্বলতা

১৯৬০ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬১-৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭২ সালে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও ১৯৭৬ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের দুইবার সভাপতি এবং বার কাউন্সিলের অর্থনৈতিক কমিটির সদস্য ছিলেন।

১৮৭৭ সালের কোম্পানি আইন সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯১৩ সালের আইন সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (BIISS)-এর বিকল্প চেয়ারম্যান এবং পরবর্তীতে চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (BLAST)-এর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দৃঢ় অবস্থান

১৯৭৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ক বহু সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।

সংবিধান ও গণমাধ্যম রক্ষার যোদ্ধা

তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সিভিল আইনজীবী। ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে আদালতের একতা বিনষ্টের বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টে জোরালো অবস্থান নেন এবং ১৯৮৯ সালে সংশোধনী বাতিল হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে সরকারের নির্দেশনার বিরুদ্ধে তিনি সাপ্তাহিক ‘যায় যায় দিন’, ‘রোববার’, ‘মানবজমিন’সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের পক্ষে আদালতে দাঁড়ান এবং সফল হন।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দৃপ্ত বক্তব্য ও সক্রিয় ভূমিকার জন্য তিনি ১৯৮৩ ও ১৯৮৭ সালে কারারুদ্ধ হন। ১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসন থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসার প্রক্রিয়ায় তার আইনি পরামর্শ ছিল অগ্রণী। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো প্রণয়নেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার এই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সাপ্তাহিক ‘যায় যায় দিন’ তাকে ১৯৯৫ সালে ‘ডেমোক্রেসি অ্যাওয়ার্ড’ স্বর্ণপদকে ভূষিত করে।

উপদেষ্টা হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন

১৯৯৬ সালে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে এবং ২০০১ সালে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার পথে কার্যকর ভিত্তি স্থাপন করেন।

সমাজ ও সংস্কৃতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ

ঢাকা নর্থ রোটারি ক্লাবের সভাপতি ছিলেন ১৯৭০-৭১ সালে। বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ইতিহাস পরিষদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD)-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আইন ও মানবাধিকার সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলোর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল নীতি ও আদর্শভিত্তিক।

পারিবারিক জীবন ও উত্তরাধিকার

১৯৫৫ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদের সঙ্গে, যিনি ছিলেন দেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক। ২০২০ সালে সুফিয়া আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। তাদের দুই সন্তান—প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ এবং চিকিৎসক রাইনা আহমেদ।

বিদায় ও প্রেরণার স্মারক

২০০৩ সালের ১২ জুলাই, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। আজ, তার ২২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশের আইন অঙ্গন, বিচার ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র তাকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে। তিনি ছিলেন নির্ভীক, প্রজ্ঞাবান ও মানবতাবাদী এক আইনজীবী, যিনি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার চিন্তা, কর্মকাণ্ড ও নৈতিকতা আজও দেশের বিচারব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি।